২৬ বছরের যুবক নাছির। লাগোয়া একটা টং দোকানের মালিক। চা, পিঠা, বিস্কুট ছিল তার দোকানের সামগ্রী। এক ভোরে নাছিরের টং দোকানের সামনে এসে স্থানীয় লোকজন দেখতে পান, দোকান খোলা, কিন্তু ভেতরে মানুষ নেই। খুঁজতে গিয়ে দেখেন, দোকানের ভেতর পিঠার পাতিল আর বেড়ায় রক্তের দাগ। ভয়ে তারা চিৎকার করে ওঠেন তারা। চিৎকার চেঁচামেচিতে আরও লোকজন জড়ো হন। সবাই মিলে খুঁজতে বের হন। খেয়াল করেন, মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের টুকরো টুকরো দেহখণ্ড। আবিষ্কার করেন, প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানবদেহের খণ্ডিত অংশ। টুকরোগুলো মহাসড়কে চলমান যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে আরও বহুদূর ছড়িয়ে পড়েছে। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। সংগ্রহ করা হয় মানবদেহের ছিন্নভিন্ন অংশগুলো। দেখা যায়, এটা নাছিরের দেহ। অনুমান করা হয়, রাতে টং দোকানেই কুপিয়ে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে মহাসড়কে ফেলে দেয়া হয়। এই হতভাগ্য, নৃশংসভাবে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়া নাছির উদ্দীনের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মাধাইায়া ইউনিয়নের নাওতলা গ্রামে। তার বাবার নাম রবিউল্লাহ। নাছির টং দোকান চালাতেন কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নাওতলা এলাকায়।
নাছিরের খুনের খবর দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইনে বের হয়েছে ‘মহাসড়কে ছড়ানো-ছিটানো লাশের টুকরা’ এই শিরোনামে ১৩ জানুয়ারি ২০২০ সোমবার। ওই দিন ভোরেই ঘটনাটি ঘটে বলে অনুমান করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, নাছিরের দোকানের পাশেই নাওতলা এলাকার বাচ্চু চেয়ারম্যান মার্কেটে নৈশপ্রহরীর কাজ করেন তার বাবা রবিউল্লাহ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গতকাল রাতে শরীর খারাপ লাগায় আমি আগে আগে বাড়ি চলে যাই। ভোরে এসে দেখি দোকানে নাসির নেই, কিন্তু দোকান খোলা। ক্যাশবাক্সে টাকা পড়ে আছে। পরে স্থানীয় লোকজন নিয়ে ওর শরীরের টুকরো টুকরো অংশ মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুড়িয়ে নিই। কারও সঙ্গে আমাদের শত্রুতা ছিল না। কারা এই কাজ করল, আমি জানি না। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
পত্রিকাটি জানাচ্ছে, চান্দিনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল ফয়সল বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, নাছিরকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে মহাসড়কে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর লাশের বিভিন্ন অংশ যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে যায়। দোকানে রক্তের ছোপ পাওয়া যাওয়ায় মনে হচ্ছে, দোকানেই তাকে হত্যা করা হয়।
এটা পরিষ্কার খুনি কারা, কেন খুন করল, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এখন ভাববে পুলিশ। হয়তো তদন্তেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত ঘটনা। হয়তো এটার কিছুই হবে না। হাজারো ঘটনার চাপে আড়াল পড়ে যাবে এই প্রান্তিক মানুষের খুনের ঘটনাটি। এই ঘটনা সংবাদপত্রে পড়ার পরে কয়েকদিন ফলোআপ নিউজ খুঁজলাম। কোথাও কিছু পেলাম না। কিন্তু আমার মনে কতগুলো প্রশ্ন জাগল-
এক. এই খুনের মধ্যে একটা ভয়াবহ পৈশাচিকতা ও প্রতিশোধ স্পৃহা আছে। নইলে একজন মানুষকে খুন করে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলতে হবে কেন?
দুই. নাছির পেশায় টং দোকানদার। খুবই প্রান্তিক মানুষ। তার পক্ষে অন্যের এতবড় বিরাগভাজন হবার মত কি কাজ তিনি করলেন? খুনিরা দোকানের ক্যাশবাক্সে হাত দেয় নাই। নাছিরের বাবা বলছেন, তাদের কোনো শত্রু নাই। তাহলে এই টং দোকানির আড়ালে নাছিরের কি অন্য কোনো পরিচয় ছিল? যে পরিচয়ের কাজ তাকে অনেক বড় প্রতিশোধের মুখে ফেলল?
যারা নাছিরকে খুন করল, তারা এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকেই তাদের পক্ষে ফায়সালা হিসেবে নির্ধারণ করেছে। নাছির যদি কোনো অপরাধ করেই থাকে কিংবা কারও বিরাগভাজন হওয়ার মতো কোনো কাজ করেও থাকে, তাহলে ভিক্টিম পক্ষ প্রচলিত বিচার-আচার-সামাজিক নিষ্পত্তি ব্যবস্থার চাইতে এই নৃশংস খুনকেই সঠিক প্রতিকার হিসেবে ভেবেছে। আর এই ‘প্রতিকার ভাবনাই’ আমাকে গভীরতরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
০২.
এই ভাবনার সাথে আমাদের সংসদের মান্যবর সংসদ সদস্যদের ভাবনার একটা বড় মিল পেলাম। পরের দিনই ১৪ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ছাপা হয়েছে ‘ধর্ষণকারীর একমাত্র ওষুধ গুলি করে মেরে ফেলা’ শিরোনামের এক ভয়াবহ সংবাদ। খবরটির বিশদ অংশে বলা হয়েছে-
ধর্ষণকারীদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) দু’জন সংসদ সদস্য। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ জাপার দুই সংসদ সদস্যের বক্তব্য সমর্থন করেন।
১৪ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার সংসদে এক অনির্ধারিত আলোচনায় জাপার সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে “এনকাউন্টার মাস্ট”। ধর্ষককে গুলি করে মারতে হবে। একমাত্র ওষুধ পুলিশ ধরার পর ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘ধর্ষণকারী ধরা পড়েছেন। ওই ছাত্রী তাকে শনাক্ত করেছেন। ধর্ষক পুলিশের কাছে আছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হোক।’
ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে যদি এই সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে চান, তাহলে এনকাউন্টার মাস্ট। তাকে গুলি করে মারতে হবে।’
এর আগে অনির্ধারিত আলোচনায় ধর্ষণ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনার সূত্রপাত করেন জাপার সংসদ সদস্য মুজিবুল হক। তিনি বলেন, ‘যে হারে ধর্ষণ বেড়েছে, সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে তা কন্ট্রোল হচ্ছে না। অনুরোধ থাকবে ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করার।’
মুজিবুল হক বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলব, আপনার সরকার, মন্ত্রণালয় এত ঘটনা ঘটছে মাদকের জন্য, এত ক্রসফায়ার হচ্ছে, সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ, জঘন্য ঘটনার জন্য কেন একজনও বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি, আমি জানি না। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, এই বিষয়টা সরকার যদি গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে কোনোক্রমেই এটা কন্ট্রোল হবে না।’
জাপার দুই সংসদ সদস্যের বক্তব্যে সমর্থন জানান সরকারি দলের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ভারতে এক চিকিৎসক বাস থেকে নামার পর চারজন ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। দু’দিন পর ক্রসফায়ারে তাদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর ভারতে আর কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
ফিরোজ রশীদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এখানে দরকার কঠোর আইন করা। আর দ্বিতীয়ত হলো, যে এই কাজ করেছে, তার আর এই পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নেই।’
তরিকত ফেডারেশনের সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বলেন, ‘আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি, এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে কোনো অসুবিধা নাই।’
০৩.
আমাদের বর্তমান সংসদের সংসদ সদস্যরা বিশেষ করে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক, তরিকত ফেডারেশনের সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ধর্ষণ রুখতে ক্রসফায়ারকে জায়েজ ভাবছেন। শুধু ভাবেনই নাই, সংসদে দাঁড়িয়ে ক্রসফায়ারের পক্ষে মত দিয়েছেন এবং অতীতের সব ক্রসফায়ারের জাস্টিফিকেশনও হাজির করেছেন। তাদের এই ক্রসফায়ার ফতোয়া কতগুলো প্রশ্নকে সামনে হাজির করছে-
এক. প্রচলিত শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের অনাস্থা।
দুই. প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় সুবিচার হচ্ছে না বলেই তারা তাৎক্ষণিক ক্রসফায়ারকেই সুবিচার ভাবছেন। অর্থাৎ নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ক্রসফায়ারকে হাতিয়ার করছেন।
তিন. এই নীতি নির্ধারকরা সংসদে দাঁড়িয়ে ক্রসফায়ারকে জায়েজ বলে ফতোয়া দিলে জনমানসে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার থোড়াই কেয়ার করছেন।
সংসদ সদস্যদের এই মনস্তত্ব খুবই খেয়াল করার বিষয়। লেখার শুরুতে যে যুবক নাছিরের কথা বলেছি, যাকে খুন করে লাশ দুর্বৃত্তরা মহাসড়কে টুকরো টুকরো করে ফেলে রেখেছে, সেইসব খুনিরা বিচার নিজের হাতে তুলে নেবার যে মনোবৃত্তি দেখিয়েছে, তার সঙ্গে উল্লিখিত সংসদ সদস্যদের মনোভাবের খুব একটা ফারাক নেই। বলা চলে, আমাদের সংসদ এক বিপজ্জনক মনোবৃত্তি সম্পন্ন একদল মানুষের হাতে চলে গেছে। যারা সুশাসন আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকে এক ভাবতে শিখেছেন। রাজনীতিবিদদের এই মনোবৃত্তি বাংলাদেশের জনমানসকে যদি প্রভাবিত করে ফেলে, তবে এদেশের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।