গেল ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এক মাসের ব্যবধানে ভাইরাসটি গোটা চীনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।
করোনার সংক্রমণে এ পর্যন্ত চীনে ৮০ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। চীন সরকার বলছে, এতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। যদিও কেউ কেউ বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ।
সংক্রমণের ভয়ে উহান শহরের মানুষকে বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিখ্যাত চীনের প্রাচীর, বেইজিংয়ের বার্ডস্ নেস্ট স্টেডিয়াম, মিং রাজবংশের সমাধি ও সাংহাইয়ের ডিজনিল্যান্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৩টি শহরে রেল ও বাস স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এয়ারপোর্টে নেয়া হয়েছে জরুরি ব্যবস্থা।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পলিটব্যুরোর এক সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে চীন। এ যেন মানবতার এক মারাত্মক সংকট। এছাড়া বিশ্বের ১২টি দেশে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের আতঙ্কে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের একটি দল এ ব্যাপারে বৈঠক করেছে। উল্লেখ্য, গত দশকে এ ধরনের বৈঠক মাত্র পাঁচ বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ বলে আতঙ্ক আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, উহান শহরের সি ফুডের দোকান, মাংস ও পশুপাখির দোকান থেকে করোনাভাইরাসটি ছড়িয়েছে। এখানে অবৈধভাবে সাপ ও পশুপাখি কেনা-বেচা চলত।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, চীনের হুবেই প্রদেশের বাসিন্দাদের অনেকেই যেহেতু চীনা কালাচ ও চীনা গোখরা (কোবরা) সাপের মাংস খান, সেখান থেকেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনে রহস্যজনকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মহামারি করোনাভাইরাসের মূল উৎস সাপ!
করোনাভাইরাস প্রাথমিকভাবে বাতাসে মিশে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ করে। এর ফলে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এরপর মানুষের হাঁচি-কাশি থেকে ছড়াতে থাকে ভয়ংকর এ ভাইরাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেরদোস আধানোম ঘেবরেইয়েসুস বলেছেন, চীনের অবস্থা নিশ্চিতভাবেই খারাপ। উহান শহরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে সেখানে মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে চলেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা।
ক’বছর পর পর বিশ্ব একটি করে নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের সম্মুখীন হয়ে থাকে। কলেরা, গুটিবসন্ত, প্লেগ ইত্যাদির দিন শেষ হলেও আমরা নিত্যনতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হচ্ছি। এজন্য মানুষের কৃষ্টি, খাদ্যাভ্যাস কম দায়ী নয়। কোনো কোনো দেশের মানুষ এমন কিছু খাবার খেয়ে থাকে, যেগুলো অন্য দেশের মানুষের মুখে রোচে না। কেউ কোনোটা খায়, আবার কেউ কোনোটার সাহায্য নেয় ও বংশবৃদ্ধি করার পরিবেশ তৈরি করে দেয়। তা না হলে প্রাণীদের মধ্যে এতদিনে সমুদয় প্রজন্মের বিলুপ্তি ঘটে যেত। এভাবে পৃথিবীতে প্রাণি জগতের মধ্যে প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রক্রিয়া চলে।
উহান শহরের সি ফুডের দোকান, মাংস ও পশুপাখির দোকান থেকে করোনাভাইরাসটি ছড়িয়েছে জানতে পেরে এক সময় বিদেশের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে অবস্থানকালীন আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা মনে হলো। সেই ছাত্রাবাসে আমরা অনেক দেশের শিক্ষার্থী একসঙ্গে থাকতাম। ক্যফেটেরিয়া থাকলেও অনেকে সেখানে নিজ হাতে রান্না করে খেত। প্রতিটি ফ্লোরে কমন কিচেনে ছুটির দিনে বেশি রান্না-বান্না চলত। রান্নার সুঘ্রাণে সেই কিচেনে কোথা থেকে একটি সুন্দর বিড়াল আনাগোনা করত। আমি মাঝেমধ্যে বিড়ালটিকে কিছু খাবার দিতাম। কিন্তু আমার মশলাদার খাবার হয়তো তার তেমন পছন্দ হতো না। আমি দেখতাম কেউ তার জন্য দোকান থেকে প্যাকেটজাত খাবার কিনে এনে দিত। আমি সেজন্য খুশি হতাম।
এরপর অনেকদিন বিড়ালটিকে দেখতে না পেয়ে আমি একদিন এক বিদেশি সহপাঠী বন্ধুকে জিজ্ঞেস করায় সে এক ভয়ংকর উত্তর দিয়েছিল। সে বলেছিল, তারা গোপনে ক’জন মিলে সেই সুন্দর স্বাস্থ্যবান বিড়ালটিকে ধরে বারবিকিউ করে উদরপূর্তি করেছে।
তাদের দেশে এটা নিষেধ নয়। সেখানে দোকানে বানর, সাপ, গুঁইসাপ, ইঁদুর সবকিছুই কিনতে পাওয়া যায়। বানরের মগজ ও সাপের স্যুপ তাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। ইঁদুরের রোস্ট তো খুব দামি খাবার।
প্রথমদিকে এসব কথা খুব অবাক হয়ে শুনতাম। পরে বিশেষ রেস্টুরেন্টে বন্য পশুপাখি বিক্রি ও অবাধে খেতে দেখে আমার ভ্রম ভেঙ্গেছিল। মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও কৃষ্টিগত পার্থক্য বইয়ে শধু নয়, হাতে-কলমে দেখে আরো নিত্য-নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। চীনের ইউয়ান ও হুবেই প্রদেশের বাসিন্দারা অনেকেই যেহেতু সাপের মাংস খায় এবং সেই সাপ থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে তা কিছুটা বিশ্বাস করতে আজ আর কোনো সংশয় নেই।
সৃষ্টিকর্তা অনেক জিনিস খাওয়ার ব্যাপারে অনেক ধর্মে ও সামাজিক বিধি-নিষেধের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ সর্বভূক প্রাণী। অনেক সমাজের মানুষ কাঁচা মাংস, মাছ খেতে ভালোবাসে। অনেকে পোকা-মাকড়, রক্ত, মাংস ইত্যাদিও কাঁচা খেয়ে ফেলে। এক শ্রেণির মানুষ মাটির ওপরের ও সমুদ্র তলার সমুদয় প্রাণী কাঁচা খেয়ে ফেলতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা জানি, অনেক প্রাণি মানুষের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু বহন করে থাকে।
প্লেগ, এনথ্রাক্স, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, মার্স ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাস, নিপাহ ভাইরাস, করোনাভাইরাস সবকিছুই কোনো না কোনো পশু-পাখি দ্বারা আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই এ সব পশু পাখি পালন, সংরক্ষণ, এদের রক্ত, মাংস, চামড়া, পালক, নখ, বিষ্ঠা, উচ্ছিষ্ট ইত্যাদির ব্যবহার থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষ করে পোষা পাখি ও প্রাণী পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পালন করতে হবে। এদের নিয়মিত টিকা দিতে হবে, গোসল করাতে হবে। পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যগত দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে।
সংক্রামক রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে সতর্কতা ও খাদ্য গ্রহণের বিধি-নিষেধ অনেকাংশেই উপকারে আসে। তাই প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সবাইকে খাদ্যাভ্যাসের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। তাহলে করোনাভাইরাসের মত মহামারিগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া বেশি সহজ হবে।
মানুষের লাগামহীন অনিয়ম ও অসতর্কতার জন্য বারবার কঠিন রোগবালাই এসে মানব সভ্যতার চলার গতিকে যেন রুদ্ধ না করে, মানবতাকে যেন ভড়কে না দেয়, বিশেষ করে মানুষের বৈশ্বিক উন্নয়নের গতি-প্রকৃতিকে যেন ধসিয়ে না দেয়, সেজন্য জরুরিভাবে আমাদের সবার সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।