নির্বাচনের দিন সবচেয়ে মজা হলো অন্যরকম ঢাকা। যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাজধানীর রাজপথ ফাঁকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা মিডিয়ার গাড়ি আর রিকশার অবাধ বিচরণ। তবে এই আনন্দ আমার খুব বেশি উপভোগ করা হয়নি। ভোট শুরুর আগেই অফিসে পৌঁছতে হয়েছে। মোহাম্মদপুর থেকে কারওয়ানবাজার আসতে মিনিট পাঁচেক লেগেছে। তারপর দিনভর অফিসেই কেটেছে। তবে অফিসে বসে বসেই রিপোর্টারদের কাছ থেকে পেয়েছি নির্বাচনের চালচিত্র।
যথারীতি অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইভিএম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ছিল উৎসবমুখর পরিবেশও। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম। আর সবচেয়ে হতাশা ছিল ভোটারদের অনুপস্থিতি।
প্রথমবারের মত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়েছে ইভিএম’এ। ইভিএম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। যারা ভোট দিতে পেরেছেন তারা খুবই উৎফুল্ল। তবে ইভিএম’এ ভোট দিতে সময় একটু বেশি লেগেছে বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। অবশ্য প্রথমবার বলে বিষয়টি নিয়ে কৌতুহল যেমন ছিল, বিভ্রান্তিও ছিল। তবে কোথাও কোথাও ইভিএম মেশিন হ্যাং করার অভিযোগ ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগ ছিল, তা হলো ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলা। কারণ আঙুলের ছাপ না মিললে মেশিনটি ঐ ভোটারের জন্য খুলবে না। তবে এই সমস্যারও সমাধান ছিল। প্রথমত নির্বাচনী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ভোটারকে ভালো করে হাত ধুয়ে আসতে বলেন। অনেকে ৫/৭ চেষ্টা করেও পারেননি। তবে আঙুলের ছাপ না মিললেও জাতীয় পরিচয়পত্রের অন্য তথ্য মিলিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তা তার আঙুলের ছাপ দিয়ে মেশিনটি খুলে দিয়েছেন। তবে নির্বাচনী কর্মকর্তা মাত্র এক শতাংশ ভোটারের জন্য তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। যেমন কোনো বুথে যদি ৫০০ ভোটার থাকে, তাহলে ৫ জনের জন্য তিনি মেশিনটি খুলে দিতে পারবেন। তবে এর চেয়ে বেশি ভোটারের ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ না মিললে নির্বাচনী কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আঙুলের ছাপ না মেলার এই বিড়ম্বনায় পড়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই। তাকেও বিকল্প পন্থায় ভোট দিতে হয়েছে। এইটুকু ভোগান্তি, বিভ্রান্তি, হয়রানি বাদ দিলে ইভিএম বিষয়টি আমার কাছে খারাপ লাগেনি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগে আর পরে আমাদের প্রযুক্তির কাছে যেতেই হবে।
সব নির্বাচনের মত এবারও বিরোধী দলের প্রার্থীরা এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়া বা বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। তবে অনেক কেন্দ্রে বিরোধী দলের এজেন্টরা ভয়ে ঢুকেনইনি। আর টুকটাক সংঘর্ষ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া যা হয়েছে তা বেশিরভাগই কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে। নৌকায় ভোট দেওয়ার অভিযোগে মারধোরের অভিযোগও এসেছে।
অনেকদিন পর কোনো নির্বাচনে জমজমাট প্রচারণা ছিল এবার। অন্তত প্রচারণায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কিন্তু টানা ২০ দিনের জমজমাট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রচারণার সাথে বেমানান ছিল ভোট কেন্দ্রের সামনের চিত্র। এত মানুষ যারা এতদিন প্রচারণায় মাঠে ছিলেন নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে; তারা এখন কোথায়? টুকটাক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে নির্বাচনের পরিবেশ খারাপ ছিল না। ভয়ে ভোট দিতে যাওয়া যাবে না, এমন অভিযোগ অন্তত ছিল না। জাতীয় নির্বাচনে যাই হোক, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেহেতু প্রার্থী বেশি, তাই তারা ভোটারদের কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু এবার তাদের সে চেষ্টাও সফল হয়েছে বলা যাবে না। কাউন্সিলররা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে যত ব্যস্ত ছিলেন, ভোটারদের কেন্দ্রে আনার ক্ষেত্রে ততটা ছিলেন না। তাছাড়া যানবাহন না চলায়ও অনেকে ভোট দিতে পারেননি। কারণ ঢাকার বেশিরভাগ মানুষই হয় ভাড়াটে, নয় ভাসমান। দেখা গেল কেউ ভোটার হয়েছেন হাটখোলায়, কিন্তু এখন থাকেন উত্তরায়। তিনি কীভাবে ভোট দিতে যাবেন। ভোটার কম থাকা নিয়ে অভিযোগ ছিল সবারই। দুই দলের চার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আগে থেকেই ভোটারদের কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
ভোটের দিন সকাল থেকেও বারবার তারা ভোটারদের কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। র্যাবের মহাপরিচালকও সবাইকে নির্ভয়ে কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন স্বয়ং সিইসিও। তবে তিনি দায় চাপিয়েছেন প্রার্থীদের ঘাড়ে। তিনি বলেছেন, আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করেছি, ভোটারদের আনার দায়িত্ব প্রার্থীদের। দায়িত্ব যারই হোক, মানুষ কেন্দ্রে যায়নি, এটাই বাস্তবতা। তবে কোনো নির্বাচনেই শতভাগ মানুষ ভোট দিতে যান না।
অন্তত ৫০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে গেলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তবে এর কম হলেই যে ভোট বাতিল হয়ে গেছে বা যাবে; তেমন কোনো কথা নেই। যত কমই হোক, যারা ভোট দিতে আসবে তাদের মধ্যে যিনি বেশি ভোট পাবেন, তিনিই জয়ী হবেন। তবে ২০ ভাগ মানুষের ভোটে পাওয়া জয় আইনগতভাবে ঠিক থাকলেও নৈতিকভাবে শক্ত হয় না।
সিইসির কথার সাথে আমি একমত। তারা পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। আসলে এবার প্রার্থী ছিল, কেন্দ্র ছিল, ইভিএম ছিল, সাংবাদিক ছিল, পর্যবেক্ষক ছিল; খালি ভোটার ছিল না। এই না থাকার বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশন, সরকারি দল, এমনকি বিরোধী দলকেও গভীরভাবে ভাবতে হবে গণতন্ত্রের স্বার্থে। সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনে মানুষ আসলে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আগে একাধিকবার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারার বা ভোটে জনমত প্রতিফলিত না হওয়ার অভিযোগ অনেককে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী করে তুলেছে। অনেকেই মনে করছেন, আমি না গেলেও তো কেউ না কেউ আমার ভোটটি দিয়ে দেবেন। ভোটের প্রতি এই অনাগ্রহ, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি এই অনাস্থা আমাদের গণতন্ত্রের গভীর সঙ্কটকে আরো প্রলম্বিত করবে। মানুষ যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট কেন্দ্র্রে যায়, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারে; তা নিশ্চিত করতে হবে এখনই।
প্রভাষ আমিন: হেড অফ নিউজ, এটিএন নিউজ