ধানমন্ডি ১৫ নম্বর ওয়ার্ড, যেটাকে ধানমন্ডির প্রাণকেন্দ্র ধরা হয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী কে ছিলেন- আমি গত এক মাসেও জানতে পারিনি। তার কোনও পোস্টার-প্রচারণা চোখে পড়েনি। এমনকি ১ ফেব্রুয়ারি ভোট দিতে গিয়ে তার কোনও অস্তিত্ব দেখিনি। মহিলা কাউন্সিলরের জন্য সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী কে ছিলেন- তাও জানতে পারিনি।
কয়েকজনের কাছে কৌতূহলবশত তাদের নাম জানতে চাইলাম-কেউ তাদের নাম জানে না, মার্কাও জানে না।
ধানমন্ডির এ ওয়ার্ডটি যেন-তেন ওয়ার্ড নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ওয়ার্ডের ভোটার। তিনি সিটি কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন। আমি ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়েছিলাম। ওই ওয়ার্ডের কাকলি স্কুল, ওয়ার্ড ব্রিজ স্কুল কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। কোথাও বিএনপির মেয়র, কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টার দেখিনি, ভোটারদের সাহায্যের জন্য যে অস্থায়ী অফিস খোলা হয়, তাও ছিল না। বলা যায়, আশপাশের ওয়ার্ডে মেয়র প্রার্থী, কাউন্সিলরের পোস্টার দেখলেও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে দেখিনি। কাউন্সিলর নেই মানে ওই ওয়ার্ডে তাদের মেয়রের প্রচারণাও নেই।
নির্বাচনী প্রচারণাকালেও লক্ষ্য করেছি, বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনের কোনও পোস্টার ওই এলাকায় ছিল না।
ধরে নিলাম, সরকারি দল তাদের সেটা করতে দেয়নি। পোস্টার লাগাতে এলে ছিঁড়ে ফেলেছে বা হুমকি দিয়েছে (যদিও এমন কিছু ঘটেছে বলে কোনও খবর দেখিনি বা শুনিনি)। সে কারণে আমার মনে প্রশ্ন ছিল, এমন একটা ছেলেখেলা নির্বাচন করে, বিএনপি কী করে মেয়র পদে জেতার আশা করেছিল এবং জিততে পারেনি বলে ‘হরতাল’ ডাকল! এসব কথা নির্বাচনের আগে বলিনি কারণ কেউ কেউ হয়তো পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনতেন।
বিএনপি তো ভালো করেই জানে যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্ভর করে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, প্রচারণা, জনশক্তি আর সরকারের ভূমিকার ওপর। এর কোনটাতে তারা এগিয়ে ছিল?
একটি উদাহরণ দিচ্ছি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের আলোচিত কাউন্সিলর প্রার্থী আলেয়া সারোয়ার ডেইজি পরাজিত হয়েছেন। লাটিম প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শফিকুল ইসলাম সেন্টুর কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছেন তিনি। কারণ একটাই- সরকারি দলের প্রার্থী হলেও ডেইজির ছিল না জনবল এবং পেশীশক্তি। সেটা ছিল জাতীয় পার্টির প্রার্থীর।
পুরো সিটি নির্বাচনের দিকে তাকালে মনে হয়, বিএনপি হারার জন্যই খেলতে নেমেছিল। দু’জন প্রার্থী দিয়েছে, তারা তুলনামূলক নবীন এবং দুর্বল। দু’জনেরই সামান্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। একজন তাবিথ আউয়াল, যিনি গতবার ঢাকা উত্তর থেকে মেয়র নির্বাচন করেছেন, ভয়কট করেছেন, মেয়র আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকলেও কাজে লাগাননি। শুধু তাই নয়, ঢাকা উত্তরের ভবিষ্যৎ প্রার্থী হিসেবেও তার কোনও তৎপরতা ছিল না। পাঁচ বছর পর আগের মতোই সরাসরি নাজেল হয়েছেন। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন ছিলেন সব দিক থেকে কাঁচা।
বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা প্রচারণায় বলেছেন ‘ঢাকাবাসীর পাহাড়সম সমস্যার সমাধান, লুণ্ঠিত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রের মাতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে’ ভোটাররা যেন ধানের শীষে ভোট দেন। কেউ কী বিশ্বাস করেছে, তাদের প্রার্থীরা সিটির পাহাড়সম সমস্যার সমাধানের যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং নির্বাচিত হলে তারা সরকার থেকে সে সহায়তা পেতেন? তাদের কোনও ক্ষমতা আছে, মেয়র হলে খালেদা জিয়াকে জেলমুক্ত করার?
একে তো দুর্বল প্রার্থী দিয়েছে, তার ওপর ইভিএমে ভোট নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রচারণায় ছিল বিএনপি। ডে-ওয়ান থেকে তারা ভোটে ফোকাস না দিয়ে ইভিএমের বিরুদ্ধে লেগে ছিল। নেতিবাচক প্রচারণায় ছিল।
ইভিএমএ ভোট হচ্ছে বলে সিল মারার সুযোগ নেই। তাপস যদি এক ভোটে হেরে যান- এ আশঙ্কায় আমার চেনা আওয়ামী লীগের একজন সত্তরোর্ধ অসুস্থ ভোটার ভোট দিতে গেছেন ধানমন্ডিতে। বিএনপি ছিল তার উল্টো। তাদের সমর্থকদের তারা এই মেসেজ দিয়ে আসছে যে ভোট যেখানেই দিক না কেন কাউন্ট হবে নৌকায়, সরকার ইভিএম করেছে ভোট জালিয়াতি করার জন্য। ফলে ব্যাপকহারে তারা ভোট বিমুখ ছিল।
অথচ ঘটনা হতে পারতো উল্টো। বিএনপির একমাত্র শক্তি ছিল জনসমর্থন। তারা সেটাকেও কাজে লাগাতে পারেনি। ইভিএম ছিল তাদের ভোট সুরক্ষার হাতিয়ার। কারণ হাতের আঙুল না মিললে একজনের ভোট আরেকজন দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ না এলে তার ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। রাতেই সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ নেই। নির্ধারিত সময় ভোটের দিন সকাল ৮টার আগে সেখানে ভোট দেওয়ার কোনও সুযোগই রাখা ছিল না। সে কারণেই দেখা যাচ্ছে, ইভিএমে এই পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, সবটাতে ভোটের হার কম। এবারও উত্তরে ভোট পড়েছে ২৫ শতাংশের মতো আর দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। উল্লেখ্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ঢাকা উত্তরের এবং ফজলে নূর তাপস দক্ষিণের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থীদ্বয়কে তারা প্রায় দুই লাখ করে ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন।
বিএনপির উচিত ছিল ইভিএমকে শক্তি বিবেচনা করে দলে দলে লোকজনকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানানো। এমনিতে ভোট কেন্দ্রের বাইরে যদি সমর্থক-কর্মীরা দলবেধে থাকে, ভেতরে পোলিং এজেন্টরাও শক্তি পায়। বিএনপি যুক্তি দেবে, ভোট কেন্দ্রের ভেতরে বাইরে পুলিশ আর আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাদের থাকতে দিত না। বিএনপি কি এমন ১০ জন পোলিং এজেন্ট, নেতা দেখাতে পারবে- যারা কেন্দ্রের বাইরে-ভেতরে পুলিশ বা আওয়ামী লীগের কর্মী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আমি অন্তত এমন কোনও দৃশ্য বা খবর দেখিনি। তারা যদি ভোটের কারণে কেন্দ্রে গিয়ে গ্রেফতার হত- সবাই তা দেখতো। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হত, যেখানে বিএনপি নেতা কর্মীরা হামেশাই গ্রেফতার হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে নির্বাচন কি সহি হয়েছে? সরকারি দল কি জোর করেনি? না সহি নির্বাচন হয়নি। সরকারি দল জোর করেছে। আর এ দেশে সহি নির্বাচন জনগণ কখনো দেখেনি, এমন কি ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনও না। সেটিকে তুলনামূলক ভালো নির্বাচন বলতে পারি আমরা। আমাদের এখানে জোর যার ভোট তার। মাঠে নেই তো ভোটের বাক্সেও নেই।
ইভিএমে ভোট কারচুপির সুযোগ না থাকলেও অভিনব উপায়ে সরকারি দল তাদের সুবিধা নিয়েছে এবার। অনেক স্থানে বুথে কালো কাপড়ে ঢাকা জায়গায় সরকারি দলের লোক উঁকি দিয়ে বা সরাসরি প্রবেশ করে- তাদের মার্কায় বোতাম টিপতে বলেছে। সেটা মিডিয়ায়ও এসেছে। আমি নিজেও সেটা উপলব্ধি করেছি। আমি যখন মেয়র পদে ভোট দেওয়া শেষ করেছি, একজন আমাকে কাপড়ের বাইরে পেছন থেকে তাদের পছন্দের কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিতে বলে। আমার এমনিতে বিকল্প ছিল না। কারণ অন্য কারও অস্তিত্বই আমি পুরো ওয়ার্ডে দেখিনি- সেটা শুরুতে বলেছি। ফলে আমি এটাকে সরকারি দলের জোর হিসেবে দেখছি না, বিএনপির দুর্বলতা হিসেবে দেখছি।
বিএনপির নেতাকর্মী, পোলিং এজেন্ট থাকলে এই জোর কেউ করার সাহস রাখতো না। সাহস রাখলেও সেটা কাজে দিতো না। আচ্ছা তেজগাঁও এলাকায় কিছু কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আওয়াল যে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলামের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন- সেটা কীভাবে সম্ভব হল! সোজা হিসাব- সেখানে বিএনপির সমর্থক পরিপূর্ণ ছিল। নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে ছিল। তাই জোর করে তাদের ভোট কেউ অন্য মার্কায় দিতে পারেনি। দুই সিটি নির্বাচনে যা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিও তাই করতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেটা অতি সহজে করতে দিত কি না- আমি সন্দিহান। বিএনপির কর্মী আর আওয়ামী লীগের কর্মীর মধ্যে তফাত এখানেই।
সব দোষ সরকারের ওপর দিয়ে, আর জন দুর্ভোগের জন্য হাস্যকর হরতাল না ডেকে, নিজেদের নেতৃত্বের দুর্বলতাগুলোও দেখা উচিত বিএনপির। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ভোটের জন্য নগর চষে বেড়িয়েছেন। তাদের সমর্থকরা কাউন্সিলর প্রার্থী আর মেয়র প্রার্থীর লিফলেট, ভোটার স্লিপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভোট ভিক্ষা করেছে। বিএনপির মেয়র প্রার্থীরাও মাঠে চষে বেড়িয়েছেন। তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও মাঠে দেখেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের মত তারা সব যায়গায় ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যেতে পারেননি বা যাননি।
ভোট কেন্দ্রে ভোটার আনার চেষ্টা না করে, নেতাকর্মীদের ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত না করে, বিএনপি প্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন, তা অভাবনীয়। আমার ধারণা, নির্বাচনকে তারা চ্যালেজ্ঞ হিসেবে নিলে, ভোটারদের মধ্যে ভয় ভীতি সঞ্চার না করে দলে দলে ভোট কেন্দ্রে আসতে বললে ফলাফল আরও চ্যালেঞ্জিং হতো। বিএনপি নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় একটি দল। সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর নেতৃত্বের অভাব দলে প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে- একটির পর আরেকটি নির্বাচনে হারের মধ্য দিয়ে। শুধু সরকারি দলের ওপর সব অভিযোগ না দিয়ে, সিটি নির্বাচনে এই রকম প্রার্থী, এই রকম নেতৃত্ব, এই রকম পরিশ্রম করে- এতো ভোট পাওয়ার জন্য বিএনপির উচিত শুকরিয়া আদায় করা। পারলে খুশিতে মেজবানি দেওয়া।
আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।