কদিন আগেই ছুঁয়ে এলাম নতুন ইংরেজি বর্ষ ২০২০ সাল। এখন চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। তারপর স্বাধীনতার মাস মার্চ, যে মাসের পরেই এপ্রিলে আসবে বাংলা নতুন সাল। শুরু হবে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে বাঙালি সমাজ বরণ করবে নতুন বছর।
মূলত আশার মাস, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে পুনরুজ্জীবনের স্পর্শ লাগে। বইমেলা এক সর্বজনীন উৎসবে আলোকিত করে বাঙালির মনন আর ঋদ্ধ করে বাঙালির চিত্ত-চৈতন্য।
২১ ফেব্রুয়ারির পর বসন্ত দোলা দেয়। চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষ বিদায়ের বেদনায় বাঙালি আবাহন করে নতুন বছরকে। এভাবেই বাংলাদেশের চিরায়ত বাঙালি জীবনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি শতরূপে, শতসৌরভে আলো-রূপ-রস-গন্ধ বিলিয় দেয়।
তবে, এ কথাও সত্যি যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শাশ্বত উত্তরাধিকার বহন করলেও আমরা আবর্তিত হই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা ইংরেজি দিনপঞ্জিতে। সাংবাৎসরিক সালতামামি চলে সে সময়। কেবল লোকায়ত ব্যবসা ও কৃষকের দিনযাপনে বাঙালি দিনপঞ্জির চৈত্র মাসটি কিছু হিসাব-পত্রের গুরুত্ব নিয়ে আসে। তখন থাকে চৈত্র সংক্রান্তি। এসবই গ্রামীণ জীবনের বহুকালের বহমান আচারিক অঙ্গ।
শহুরে জীবনে বাঙালি জীবনশৈলীর কতটুকু বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তা তর্ক সাপেক্ষ বিষয়। পহেলা বৈশাখের বাইরে বাংলা সালের প্রসারিত অঙ্গনের কতটুকু ছুঁতে পারে নাগরিক জীবন, তা-ও বলা মুশকিল!
বাংলায় বা ইংরেজিতে সাল বদল হয়ে নতুন বছর এলেই দিন বদলে যায় না। জীবন ও যাপনের আটপৌরে ধারারও বদল হয় না। সমাজে, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে বিরাজমান অন্ধকারও সহজেই কাটতে চায় না। ফলে সাল বদল হলেই রাতারাতি পরিবর্তন চলে আসে না। জীবনে ও সমাজে বিদ্যমান অন্ধকার ও অপসংস্কৃতির অবসান হয় না।
অতএব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে ইতিবাচক পরিবর্তন জাতিসত্ত্বার স্বার্থে অতি জরুরি হলেও তা আপনাআপনি বা যান্ত্রিকভাবে হয় না। পরিবর্তনের জন্য, উন্নয়ন-অগ্রগমনের জন্য, বদলাতে হয় ‘মাইন্ড সেট’, গ্রহণ করতে হয় পদক্ষেপ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই জীবনকে নবায়ন করে সবুজ রাখতে হয়, এগিয়ে যেতে হয়। মানুষের এ গতিশীলতা থমকে গেলে বা বিপথগামী হলে কিংবা বিকৃত হলে আসে স্থবিরতা, অবক্ষয় এবং তৈরি হয় অচলায়তন, যার নিশ্চিত পরিণাম হলো পশ্চাৎপদতা।
হয়ত নতুন বছরের অরুণালোকিত দিনটি, কিংবা জীবনের বিশেষ দিনগুলো জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার একটি মাহেন্দ্রক্ষণ এনে দেয়। চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয় উল্লেখ্যযোগ্য দিনের পটভূমিতে। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সফলতা পাওয়ার একটি প্রত্যয় ও প্রতীতি সঞ্চারিত হয় তখন। জাগে নবপ্রাণ ও প্রণোদনার উচ্ছ্বাস। আবেগ এসে উদ্বেলিত করে। ব্যক্তিমানুষের জন্মদিন কিংবা জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এই গতি, আবেগ ও প্রণোদনার অন্তর্নিহিত শক্তিমত্তার মধ্যেই বহুলাংশে নিহিত।
জীর্ণ জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর মতো পুরনোকে ছেড়ে নতুন ও ইতিবাচকতায় উত্তরণের পথে শুধু সাল বদল না করে জীবনের প্রতিটি প্রহরে দিন বদলের চেতনায় প্রোজ্বল হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগালেই বিরাজমান অন্ধকার, পশ্চাৎপদতা, কূপমণ্ডূকতা ইত্যাদি ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে দূর হবে। আসবে আলোয় উদ্ভাসিত নতুন সম্ভাবনা। সংস্কৃতির কাজই হলো জাতির সম্ভাবনা ও ইতিবাচকতায় প্রাণপ্রবাহ বৃদ্ধি করা। যে জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি একুশের, বসন্তের, বৈশাখের।
সাংস্কৃতিক উত্তরণের চেতনাবাহী দিবস, উৎসব, আয়োজনগুলোর সঙ্গে দিন বদলের ইতিবাচক পরিবর্তন ও গুণবাচক প্রচেষ্টার মিলন ঘটালেই স্বার্থক হতে পারে সব পরিকল্পনা। নচেৎ পুরো বিষয়গুলোই অন্তঃসারশূন্য পণ্ড শ্রমে পরিগণিত হবে। বৃহত্তর ক্যানভাসের বদলে ক্ষুদ্রতা, প্রজ্ঞার বদলে রাজনৈতিক চামচামি, সৃজনের বদলে আমলাতান্ত্রিক আনুগত্যের ভণ্ডামি ও বাহানা অতীতে বহু মহৎ উদ্যোগ নস্যাৎ করেছে। দিবস ও উৎসব এসেছে ও চলে গেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সমাজ ও মানুষের জীবনে পুঞ্জিভূত অমানিশার অবসান হয়নি।
সংস্কৃতি নামক প্রপঞ্চ জীবনকে সুন্দরতম করার মাধ্যম হলেও তাকে যথাযথভাবে সপ্রযুক্ত করার অযোগ্যতা নিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কাঙ্ক্ষিত ফল নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। হয়ত পাল্টাবে পুরনো সাল, পাল্টাবে পাণ্ডুর দিনগুলো, আসবে দিবস ও উৎসব, তথাপি পরিসঞ্চালন করা যাবে না গুণগত অর্জন ও ইতিবাচক অগ্রগতি। গায়ক তার তাপিত কণ্ঠে গাইতেই থাকবে, ‘পাল্টায় সাল, বলো দিনগুলো পাল্টাবে কবে?’
দৃষ্টিগ্রাহ্য ও দৃশ্যমানভাবে মানুষের জীবনে ও সমাজ কাঠামোয় গুণবাচক পরিবর্তন ও ইতিবাচক রূপান্তরের মাধ্যমে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় এসেছে। বাঙালির জীবনকে সাংস্কৃতিক সুষমায় পূর্ণ ও অর্থবহ করে অপসংস্কৃতি, কুরুচি ও অন্যায়ের ঘোরতর অন্ধকার দূর করার মাধ্যমে এর উত্তর দিতে হবে। পরিবর্তনকে উৎসব-আয়োজনের ঘেরাটোপ থেকে মানুষের সামাজিক জীবন ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধতার বৃহত্তর কাঠামোতে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেই এই জরুরি কাজটি করতে হবে।
লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম