পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রতীক। এ ভাষা আমাদের গৌরবের ও অহংকারের। আমাদের পুরো স্বাধীনতার আন্দোলন জুড়ে আমাদের ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের প্রথম ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ভাষা আন্দোলন আমাদের অনেক সাহস যুগিয়েছে, আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। এই আত্মবিশ্বাস ও সাহস জাতীয় নেতৃত্ব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হয়েছি।
পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর একশ’ বছর কোম্পানির শাসন ও একশ’ বছর ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ শাসন থেকে ধর্মের ভিত্তিতে দু’টি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। শুধুমাত্র ধর্মগত কারণে ভৌগোলিক সীমারেখায় অনেক দূরে অবস্থান করেও আমরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হই। তারপরও তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের মেনে নিতে পারেনি। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান সেই স্বাধীনতার পর থেকে। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে স্বাধীনতার পর পাকিস্তান একটি সংবিধান রচনা করতে পারেনি। জোড়াতালি দিয়ে সংবিধান রচনা করতে সময় লেগেছিল নয় বছর, যেখানে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান রচনা করতে আমাদের সময় লেগেছিল মাত্র নয় মাস।
যে সব কারণে পাকিস্তান সরকার সর্বসম্মতভাবে একটি সংবিধান রচনা করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে, সেই বিষয়টি। পাকিস্তানিরা বোকা ভেবে প্রথমত আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে চিরতরে বিলীন করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করার পায়তারা করেছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা রুখে দেয়। এজন্য দিতে হয়েছিল শহীদ সালাম জব্বার রফিক বরকতের বুকের তাজা রক্ত। পাকিস্তানের সংবিধানে স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। বাঙালিরা বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনো বাঙালির অধিকারের মূল্যায়ন করবে না। তাই ভাষা আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে এক ধরনের জাতীয়তাবোধ জন্ম লাভ করে। ভাষা আন্দোলনে জয়লাভ এই জাতীয়তাবোধের অগ্রযাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করে।
পরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালায়। আমাদের একটি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিল। পৃথিবীর বুকে আমরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারি, সে ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত হয়েছিল।
বাঙালিরা বীরের জাতি, সহজে হার মানে না। রুখে দাঁড়ায় তাদের সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। আমাদের অধিকারের অমর্যাদা থেকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস যোগায় আমাদের ভাষা আন্দোলন। পৃথিবীতে আমাদের মত জাতি বিরল, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। প্রমাণ করেছে, বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের অহংকার। আমরা পৃথিবীর অন্যদের থেকে আলাদা।
কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পর আমরা আরো একটি ভাষা আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। যে স্পৃহা ও যে উদ্দেশ্য নিয়ে মাতৃভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানি কলোনিয়াল গোষ্ঠী থেকে রক্ষা করা হয়েছিল, যে কারণে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে আমরা আন্দোলন করেছিলাম, আজকে মনে হয় আমরাই আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে পারছি না। আমরা নতুন একটি ভাষাগত উপনিবেশবাদের সম্মুখীন। ভাষার প্রশ্নে আজ আমরা বিভক্ত। আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অবহেলিত। আমরাই আমাদের মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় শ্রেণির একটি ভাষায় রূপান্তর করছি। কাগজে-কলমে মাতৃভাষা রক্ষায় অনেক প্রণোদনা দিলেও বাস্তবে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিশ্বায়নের ফলে নব্য ও শংকর সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটে। সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও ভাষাগত হাইব্রিডাইজেশন আমাদের ওপর আবির্ভূত হয়েছে। পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ইংরেজি ভাষার প্রতি আমাদের দুর্বলতা দিন দিন বাড়তে থাকে। জাতীয়ভাবে ইংরেজি ভাষার প্রতি কেন জানি অতিরিক্ত দরদ পরিলক্ষিত হয়। ২-৪ লাইন ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারলে যেন জ্ঞানী হওয়া যায়। পুরো জ্ঞান যেন ইংরেজি ভাষার মধ্যেই লুকায়িত। আমাদের মধ্যে এমন এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয় যে যত বেশি ইংরেজি জানেন, তিনি ততো বেশি জ্ঞানী।
ইংরেজি জানা দোষের কিছু নয়। এটি অতিরিক্ত যোগ্যতা ও দক্ষতা। কিন্তু নিজের মাতৃভাষা না জেনে, শুদ্ধভাবে মাতৃভাষার চর্চা না করে ইংরেজি ভাষার চর্চা ও দক্ষতা অর্জন শুধু অন্যায়ই নয়, বড় ধরনের অপরাধও।
আমাদের স্কুল কলেজগুলোতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের মহাসমারোহ পরিলক্ষিত হয়। শিশুরা ইংরেজি বলতে পারলে শিক্ষক, অভিভাবক, মা-বাবারা অনেক গর্ববোধ করেন। একবারও প্রশ্ন করেন না, তারা শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে ও লিখতে পারে কি না।
আমাদের সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থার হাইব্রিডাইজেশন হয়েছে অনেক আগে। বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের সমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকে আমাদের সমাজের ওপর নতুন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে। তা হচ্ছে ইংরেজি ভার্সন। আমাদের বাংলা ভাষার পাঠ্যবইগুলো অশুদ্ধ ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করা হয় ইংরেজি ভার্সন। আমি উচ্চ শিক্ষার কথা বাদই দিলাম। উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজি চর্চা হতে পারে কারণ উচ্চ শিক্ষা হচ্ছে বিশেষায়িত শিক্ষা। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা হচ্ছে মৌলিক শিক্ষা। এখানে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধের একটি ভিত্তি তৈরি হবে। আর সেখানেই বড় ধরনের হাইব্রিডাইজেশন লক্ষ্য করা যায়। আমাদের সন্তানরা ভালো করে বাংলাও জানে না ইংরেজিও জানে না। তুলনামূলকভাবে বাংলার তুলনায় তারা ইংরেজি ভালোবাসে। তাদের কাছে বাংলা এক ধরনের ভীতিকর বিষয়।
ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে বাংলার তুলনায় ইংরেজির প্রতি অতিরিক্ত আহ্লাদ বাংলা ভোলাতে ভূমিকা রাখছে। অভিভাবকরা এই ধরনের হাইব্রিড স্কুলগুলোর প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আমাদের একক কোনো সমাজ নেই, একক কোনো সংস্কৃতি নেই, একক কোনো ভাষা নেই। আমরা অনেকগুলো সমাজের সৃষ্টি করেছি, আমাদের দেশের ভেতরে আরেক ধরনের দেশ তৈরি করছি, ভাষার ভেতরে আরেক ধরনের ভাষা তৈরি করছি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলা ভাষা বাংলাদেশে গুটিকয়েক মানুষের ভাষায় পরিণত হবে।
ইংরেজির প্রতি অতিরিক্ত কদর আমাদের মধ্যে এক ধরনের বিভক্তি তৈরি করছে। শহীদ সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতরা মনে মনে ভাবছেন, যে ভাষা রক্ষা করার জন্য বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছি, যাদের জন্য দিয়েছি, আজ তাদের কাছে আমাদের মাতৃভাষা অবহেলিত।
জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক আমাদের মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। মাতৃভাষা দিবস একযোগে বিশ্বের সব দেশ পালন করছে। এই অর্জন আমাদের বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
আমরা ইংরেজি ভাষার প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতা প্রকাশ করছি, তা দোষের নয়। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। আমাদের ইংরেজি জানতে হবে। তবে তা বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের মনোভাব প্রকাশ করার জন্য, সাহিত্য চর্চার জন্য ইংরেজি একটি পরিপূর্ণ ভাষা নয়। ইংরেজি আমাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত একটি দরিদ্র ভাষা। কারণ ইংরেজি ভাষা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ।
উদাহরণস্বরূপ বাংলা ভাষায় চাচা, খালু, ফুপা- এই সম্পর্কগুলোর আলাদা আলাদা অর্থ আছে। ইংরেজি ভাষায় এই সবগুলো সম্পর্ককে একটি শব্দে (আংকেল) বোঝানো হয়েছে। আমরা ফুপা বলতে যা বুঝি, চাচা বলতে তা বুঝি না, চাচাতো ভাই বলতে যা বুঝি, খালাতো ভাই বলতে তা বুঝি না, চাচি বলতে যা বুঝি, খালা বলতে তা বুঝি না। আমাদের প্রত্যেকটি সম্পর্ক আলাদা। কিন্তু ইংরেজিতে এই সম্পর্কগুলোকে অনুবাদ করতে পারেনি। আমাদের সন্তানরা আর চাচা, মামা, খালু, ফুপার মধ্যে পার্থক্য বুঝবে না। শ্যালিকা ও ভাবির মধ্যে পার্থক্য বুঝবে না। তারা বাজারে কাঁঠাল দেখবে, কিন্তু কাঁঠাল গাছ চিনবে না। পৃথিবীর আর কোনো জাতি নিজেদের ভাষা এভাবে অবহেলা করে বলে নজির নেই।
আমরা যদি ইউরোপের স্ক্যান্ডেনেভিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও এশিয়ার চীন, জাপান, কোরিয়া, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এই দেশগুলোতে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। এই দেশগুলোর শহরগুলোতে ইংরেজি মিডিয়াম অনেক স্কুল আছে। আন্তর্জাতিক শহরের পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বসবাস করে তাই তারা এই ধরনের স্কুলের ব্যবস্থা করেছে কিন্তু তাদের নিজস্ব নাগরিকদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর প্রতি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমাদের ইংরেজি ভার্সনের মত হাইব্রিড স্কুল পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই।
ভাষা আন্দোলনের মাসে মাতৃভাষার প্রতি অতিরিক্ত দরদ পরিলক্ষিত হয়। সভা সেমিনার বক্তৃতায় আমরা অনেক মুখরোচক কথা বলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার কথা বলি। সরকারি সব অফিসে বাংলা চর্চার কথা বলি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমাদের যদি ইংরেজির প্রতি এতটাই দুর্বলতা থাকে, পশ্চিমাদের প্রতি যদি আমাদের এতই ভালোবাসা থাকে, পশ্চিমা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি যদি আমাদের এতই দরদ থাকে তাহলে এত সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের তাড়িয়েছিলাম কেন? কেন পাকিস্তানিদের ও তাদের দালালদের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? আমরা কী মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছি? না। আমাদের মাতৃভাষা আজ আমাদের কাছেই অনিরাপদ।
অতএব, আসুন পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিস-আদালতে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে বাংলার চর্চা বাড়াই। বাংলা ভাষা রক্ষা করি। বাংলার মর্যাদা রক্ষা করি। ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত উপনিবেশ থেকে নিজেদের রক্ষা করি। সেজন্য প্রয়োজন- আরও একটি ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন পাকিস্তানিদের মত অন্য কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, এই আন্দোলন হবে আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে। বাংলা ভাষা রক্ষা ও চর্চায় জাতীয় আন্দোলন এখন সময়ের দাবি।
লেখক ড. মো. কামাল উদ্দিন, প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।