রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই- এই অশ্লীল কথাটিই বাংলাদেশের রাজনীতির শেষ কথা মনে হচ্ছে। এই একটি বাক্য দিয়ে রাজনীতিবিদরা অনেক অন্যায়কে জায়েজ করে ফেলেন। রাজনীতিতে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নেই, কোনো আপনপর নেই। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর অতি স্নেহের সিরাজুল আলম খান জাসদ গঠন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে বঙ্গবন্ধু সরকারকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিস্থিতি তৈরি করা জাসদ এখন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী। বঙ্গবন্ধু তাঁর কিছু হলে সন্তানদের মুশতাক চাচার কাছে যেতে বলেছিলেন। ১৪ আগস্ট রাতে নিজের বাসা থেকে হাসের মাংস রান্না করে ৩২ নম্বরে যাওয়া খন্দকার মুশতাকই পরদিন বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে রেখে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিতে গিয়েছিল। ১৫ আগস্ট ভোরে বেতারে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘোষণা দিয়েছিল যে ডালিম, ৩২ নম্বরে তারও নিত্য আসা-যাওয়া ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সকাল-বিকাল গালি দেয়া লোকজন পরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছেন। জিয়া বিশ্বাস করে এরশাদকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। আর এরশাদ ষড়যন্ত্র করে প্রথমে জিয়াকে হত্যা করেন। এবং জিয়া হত্যার বিচারের নামে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসি দিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে কেউ কি ভেবেছিল আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে, বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী হবেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাতে কেউ কি ভেবেছিল এরশাদ আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। রাজনীতিতে আসলেই শেষ কথা বলে কিছু নেই, অসম্ভব বলে কোনো শব্দ নেই। ওয়াইল্ডেস্ট গেস'ও হার মেনে যায় রাজনীতির অকল্পনীয় সব ঘটনায়।
এতসব কথা বলছি বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস প্রসঙ্গে। ২০০৬ পর্যন্ত কেউ কি ভাবতে পেরেছিল বেগম খালেদা জিয়াকে নির্জন কারাগারে বা হাসপাতালে বন্দী জীবনযাপন করতে হবে। এটা ঠিক ২০০৭ সালে ১/১১ বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল। বিএনপির আজকের দুর্দশা, খালেদা জিয়ার কারাবাস; সবকিছুর পেছনে এই ১/১১। আর ১/১১এর পেছনের মূল দায় আমি দেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। শুধু ১/১১ নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধ্বংসের জন্যও দায়ী এই চতুর ব্যারিস্টার। বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে পছন্দের বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর ব্যবস্থা করার মধ্যেই বিএনপির ধ্বংসের বীজ লুকিয়েছিল। তারপর ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টা বনে যাওয়া, বঙ্গভবনে বসে হাওয়া ভবনের নির্দেশে দেশ চালানো ১/১১কে অনিবার্য করে তোলে। যার মাশুল আজ দিতে হচ্ছে বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন। এই পদে তিনি আছেন সেই ১৯৮২ সাল থেকে। তিনি বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সাবেক সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। সারাজীবনই তিনি যাপন করেছেন বিলাসী জীবন। কিন্তু ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সেই জীবনে ছেদ পড়ে। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিনি কারাগারে আছেন টানা দুইবছর! ভাবা যায়?
বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস এই প্রথম নয়। ওয়ান ইলাভেনের সময় প্রথমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পরে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে তাদের দুজনকে তখন রাখা হয়েছিল সংসদ ভবন এলাকার দুটি ভবনে। ভবন দুটিকে বিশেষ কারাগার ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দুর্নীতির দুটি মামলায় কারাভোগ করছেন বেগম খালেদা। একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা-খালেদা নাম দুটি এক ব্র্যাকেটে উচ্চারিত হতো। আজ শেখ হাসিনা নিজেকে তুলে নিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। আজ নিছক বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় সস্মানের সাথে। আর খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাগারে থাকা এক ভুলে যাওয়া নাম।
বিএনপি দাবি করছে, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা রাজনৈতিক। কিন্তু সরকারি দল বলছে, এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা স্পষ্ট দুর্নীতির মামলা। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে নিম্ন আদালত রায় ঘোষণা করেছে। সরকারি দলের নেতাদের দাবি, এ সাজায় সরকারের কোনো হাত নেই। যে যাই বলুক, বেগম খালেদা জিয়া দুই বছর ধরে কারাগারে আছেন, এটাই বাস্তবতা। যদিও নজিরবিহীনভাবে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে একজন সহকারী দেয়া হয়েছে। তারপরও নানান রোগব্যাধিতে আক্রান্ত ৭৫ বয়সী একজন নারীর কারাগারে থাকা অবশ্যই কষ্টকর। আবার তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে কারাগারে আছেন, এটাও লজ্জাজনক।
এখন ৭৫ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়ার ভবিষ্যৎ কী? তাকে কি ১৭ বছরই কারাগারে থাকতে হবে? এটা ঠিক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বেগম জিয়ার জন্য খুব বেশি সুখবর নেই। খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার চারটি উপায় আছে। এক নম্বর উপায়, আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্তি। তবে বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বুঝে গেছেন, এই রাস্তায় হবে না। জামিনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আরেকটি প্রক্রিয়া হলো, রাজপথে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলা। দেশে-বিদেশে আন্দোলন করে মুক্তির এমন অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় যেমন সম্ভব নয়, রাজপথের আন্দোলনেও যে সম্ভব নয়, সেটাও বিএনপি দুই বছর ধরেই বুঝিয়ে দিয়েছে। এই দুই বছরে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কোনো সিরিয়াস চেষ্টা করেনি। ইশরাক বা তাবিথের নির্বাচনী প্রচারণায় হাজার হাজার মানুষ; কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ১০০ নিবেদিতপ্রাণ কর্মীও নেই। এ বড় বেদনাদায়ক। বিএনপি আন্দোলন করতে গেলে সরকার বাধা দেয়, পুলিশ পেটায়; এ বড় সত্য অভিযোগ। কিন্তু বিএনপি যে আন্দোলনের ধারটাই হারিয়ে ফেলেছে, এ তো মিথ্যে নয়। সিটি নির্বাচনের পরদিন ডাকা হরতালে বিএনপির সিনিয়র নেতারা কেউ মাঠে নামলেন না। পুলিশ বিএনপির আবাসিক নেতা রিজভি আহমেদকে ৩০ মিনিটের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করতে বললেন; তিনি তিন মিনিটের মধ্যে নয়াপল্টনের খোয়াড়ে ঢুকে গেলেন; এ দায় কার- পুলিশের না বিএনপির?
আইনি প্রক্রিয়া এবং রাজপথের আন্দোলনে সম্ভব নয়, এটা জানার পর বেগম জিয়ার মুক্তির আর দুটি উপায় আছে। বেগম জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা চাইতে পারেন। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে, রাষ্ট্রপতি তাকে মার্জনা করতেও পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে অপরাধ স্বীকার করে নিতে হবে। এরপরের প্রক্রিয়া হলো, প্যারোল। কিন্তু প্যারোল পেতে হলেও বেগম জিয়াকে আবেদন করতে হবে। সরকার সন্তুষ্ট হলে বেগম জিয়াকে প্যারোল দিতে পারে। এই দুটি প্রক্রিয়ার জন্যই সরকারের সাথে আপস করতে হবে। 'আপসহীন' নেত্রী সেটা করবেন কিনা বা তার দল তাতে আগ্রহী কিনা; প্রশ্ন এখন সেটাই। অনেকবার অনেক সমঝোতার গুজব শুনেছি। ভেবেছিলাম বিএনপি সংসদে যোগ দেয়ার বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি গত দুই বছরে বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে আদালতে, রাজপথে, সংসদে, পর্দার সামনে, পেছনে কোথাও বিএনপির কোনো সিরিয়াস মুভ দেখিনি। সবাই যেন বেগম জিয়াকে ভুলে গেছে। এ বড় দুঃখজনক।
অপরাধ যাই হোক, সারাজীবন অভিজাত জীবনযাপন করা বেগম খালেদা জিয়ার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে থাকা বা বিএসএমএমইউ'র কেবিনে থাকার বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু এখন ভাবছি, এটা আসলে তার নিয়তি। ৩৮ বছর ধরে তিনি ভুল দলের পেছনে সময় দিয়েছেন, ভুল নেতাকর্মী তৈরি করেছেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সাহসী সৈনিকরা আজ প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে যেন। সবাই ভয়ে অস্থির।
সাহসী নেতৃত্বই পারতো বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে। কিন্তু বিএনপি নেতাদের কারো মুখেই সেই সাহসের আভা দেখিনি। আর সেটা নেই বলেই 'আপসহীন নেত্রী'র মুক্তির বিষয়টি আজ সরকারের অনুকম্পার ওপর নির্ভর করছে।
আন্দোলন করার সক্ষমতা হারিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা আজ দৈব কিছুর আশায় বসে আছেন। ভুলে গেছেন তাদের নেত্রীকেও। খালেদা জিয়া দুইবছর ধরে কারাগারে। কিন্তু সবাই যেন তাকে ভুলেই গেছেন। মাঝে মধ্যে পরিবারের সদস্য, সিনিয়র নেতারা দেখা করতে যান বটে। কিন্তু বিএনপির কর্মীরা তাকে মনে রাখেনি। বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে, কিন্তু কারো যেন কিছু যায় আসে না। ৩৮ বছর ধরে খালেদা জিয়া কাদের নেতৃত্ব দিলেন, তার গড়া কর্মীরা কোথায়? এই দুই বছরে একজন নেতাকর্মীও কারাগার বা হাসপাতালের সামনে গিয়ে খালেদা জিয়াকে স্মরণ করেছেন বা কান্নাকাটি করেছেন বা পুলিশের মার খেয়েছেন; শুনিনি। হায়, আসলেই রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
প্রভাষ আমিন: হেড অফ নিউজ, এটিএন নিউজ