ছোটরা পারলে বড়রা কেন পারবে না? বাংলার ক্রিকেটের ২২ গজে, সাকিব আল হাসানরা যে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন, সেই চিহ্ন অনুসরণ করেই এগোচ্ছে তানজিম হাসান সাকিবদের খেলা। পার্থক্য শুধু এটুকুই, সাফল্য এসেছে যুবাদের হাত ধরে, বড়রা এখনও পারেনি! তবে আগামীতে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম কিংবা মাহমুদুল্লাহদের সঙ্গে আকবর আলীদের দুর্দান্ত সমন্বয়ে কোটি বাঙালি আশা করতেই পারে- এবার ঘরে আসবে বড়দের বিশ্বকাপও।
তবে সে পথ দীর্ঘ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হলে করণীয় আছে বহু কিছু। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি কি আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্বটা নিতে পারবে? নাকি হেলায় হারাবে সময়?
তরুণদের বিশ্বজয়ের এ সময়টায় বড়দের বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবছি। ভাবছি মূলত সার্বিক ভবিষ্যৎ নিয়েই। তার আগে যুবাদের অভিনন্দন জানাই। তারা বীর। তারা নির্ভীক সৈনিক। আত্মপ্রত্যয়ী। তাদের খেলা, কথা বলা, চলন বলন, ভাবনা-চিন্তার জায়গাটাই অন্য রকম। তা না হলে কি তারা খেলা শুরুর আগেই বলে যে, আমরা ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতব!
ইতিহাস গড়ার লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছিল এই অকুতোভয় দামাল ছেলেরা। তারা ঠিকই ইতিহাস রচনা করে দেখিয়েছে। তাও আবার চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারিয়ে। লক্ষ্য থাকলে যে তা জয় করা সম্ভব তাই হলো প্রমাণিত। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন আমাদের ইয়াং টাইগাররা।
তরুণ তুর্কিদের এই জয়ের ধারা ধরে রাখতে হবে। এখানেই মূল চ্যালেঞ্জটা বিসিবির। আগে এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে ক্রিকেট বোর্ড। জুনিয়র পর্যায়ে আমাদের টাইগাররা সব সময়ই কম-বেশি সেরা। ঘরের মাঠে ২০১৬ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ ভালো করেছিল। খেলেছিল সেমিফাইনাল। সেই দলে ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনরা। তারা আজ জাতীয় দলে, অথচ বাংলাদেশ টেস্টে এখনও ইনিংসে হারে! ভারতে গিয়ে, পাকিস্তানে গিয়েও উপমহাদেশীয় উইকেটে নাজেহাল হয়। মিরাজ এখন খুব একটা ভালো করতে না পারায় দলেই সুযোগ পাচ্ছেন না! এক দিকে যখন তরুণরা বিশ্বজয় করছে অন্য দিকে রাওয়ালপিন্ডিতে চিরায়িত ব্যাটিং বিপর্যয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। কী নির্মম বাস্তবতা! এর পেছনের কারণটা কী? অনেকেই অনেক কথা বলবেন, তবে বড় কারণ হিসেবে দেখি অনুর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটারদের পরিচর্যা না করাকে কিংবা পুরোপুরি করতে ব্যর্থ হওয়াকে। যা ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড করে, পারি না কেবল আমরা। এখন সময় এসেছে আমাদেরও সেই পথে হাঁটার, তা না হলে বড়দের জাতীয় দলের ক্রিকেটে আমরা তলানির দল হিসেবেই থেকে যাব!
ক্রিকেটার তুলে আনার ক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ডের অবদান কতটুকু তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। ক্রিকেটার যা উঠে আসছে, তা জেলা পর্যায়ের কোচদের কারণেই। বিসিবি গেল কয়েক বছরে কী কী ট্যালেন্ট হান্টের আয়োজন করেছে শুনি! চার বছর আগে ‘রবি পেসার হান্টে’ সেরা পেসার হন এবাদত হোসেন। আজ তিনি জাতীয় দলে। কিন্তু এমন কীই বা করতে পারছেন তিনি! প্রশ্ন হলো, একটা পেসারকে বের করেই আমরা সন্তুষ্ট তাহলে! ওই হান্টে সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি ফাস্ট বোলার অংশ নেন। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ৮৬ জন ফাস্ট বোলারকে বাছাই করা হয়। এর পরের ধাপে ৫৬ জনকে মিরপুর শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে ডাকা হয়। এরপর আরেক দফা বাছাইয়ে ২৩ জনকে নিয়ে চূড়ান্ত বাছাই প্রক্রিয়ার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে ১০ জনকে চূড়ান্ত বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, আর সেরা হন একজন। প্রতিবছরই যদি এমন আয়োজন হলে চূড়ান্ত ১০ জন বাদই দিলাম, সেরা একজন করে পেলে গেল চার বছরে চারজন এবাদতকে পেতাম না আমরা? এর মধ্যে কোন এবাদত সব থেকে ভালো সেই খেলোয়াড় ঘরোয়া লিগ এবং ‘এ’ দলের মাধ্যমে জাতীয় দলে খেলত তাই নয় কি? ঠিক তেমনিভাবে স্পিনার হান্ট, ব্যাটসম্যান হান্টও হতে পারে। অন্তত লেগ স্পিনার সংকট দূর করতে বিসিবি কেন এটা করবে না!
আবার অনুর্ধ্ব-১৯-এর কথায় ফিরি। আমাদের দেশে অনুর্ধ্ব-১৯-এর পর পার্থক্যটা গড়ে ওঠে আরেকটু বড় হলে। বছর তিনেক পর। অস্ট্রেলিয়া, ভারতের ক্রিকেটাররা হয়ে ওঠেন রান মেশিন। বোলাররা 'আনপ্লেয়েবল'। আর বাংলাদেশ পায় 'ব্যাটের কানায় টোকা লাগিয়ে' আউট হওয়া ব্যাটসম্যান এবং বৈচিত্র্যহীন বোলার! যারা নিজের ছায়ায় নিজেকে খুঁজে ফেরেন! এবার এমন যেন আর না হয়। বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে না ভেসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে এখন থেকেই ভাবতে হবে। নিতে হবে দায়িত্ব। রোববার (০৯ ফেব্রুয়ারি) দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভারতের বিপক্ষে খাদের কিনার থেকে পাওয়া এ জয় শুধু উচ্ছ্বাসেরই নয়, শিক্ষারও বটে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের তিনটি স্তর ১৫, ১৭ ও ১৯-এর দিকে গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে। যেন ২০২০ সালের যুব বিশ্বকাপের সাফল্য ২০২২ সালে উইন্ডিজেও বজায় থাকে।
অন্য দিকে বিশ্বকাপ জয়ী এই ক্রিকেটারদের আরও পরিণত করে জাতীয় দলে নিতে হবে। হুট করে সুযোগ দিলে সাময়িক সাফল্য হয়ত এলেও আসতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি সাফল্যের জন্য চাই তাদের সময় দেয়া। টেস্টকে বলা হয়, ক্রিকেটের ভিত্তি। এই ভিত্তিটা তাদের মধ্যে মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত করতে হবে সার্বিকভাবে। কেউ যেন ঝরে না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে নিয়ে টানা খেলার মধ্যে রাখতে হবে তাদের। ইংল্যান্ডের শক্তিশালী ঘরোয়া ক্রিকেট দলের সঙ্গে ফাস্ট ও বাউন্সি উইকেটে খেলার আয়োজন করা যেতে পারে, খেলা হতে পারে নিউজিল্যান্ডের তীব্র বাতাসের মাঠে, প্রচণ্ড সুইং কন্ডিশনেও।
জাতীয় দলের দরজা খোলার আগে 'এ'-দল, হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) দলের হয়েও তাদের পূর্ণ পরিচর্যা করার দরকার। উপমহাদেশের ক্রিকেটে এই সংস্কৃতি রয়েছে যে কেউ বয়স-ভিত্তিক ক্রিকেটে ভালো করলে সেখান থেকে তাকে সরাসরি জাতীয় দলে সুযোগ দেয়া হয়। খুব অসাধারণ কিছু না করলে ভারত, শ্রীলঙ্কাতে তেমনটা হয় না যদিও। বাংলাদেশে হুট করে সুযোগ দেয়ার রীতি রয়েছে। এভাবে সুযোগ দেয়ার অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে বিসিবিকে। দীর্ঘ মেয়াদী ভিত্তিতে সাফল্য পাওয়ার বিষয়টি হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য। কারণ এবার যে ঘরে চাই জাতীয় দলের বিশ্বকাপ। সেই সঙ্গে টেস্টে কম করে পঞ্চম স্থান। একটু ভেবে চিন্তে, পরিকল্পনা করে এগুলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন ২০২৭ কিংবা ২০৩১-এর আইসিসি মূল বিশ্বকাপও হবে আমাদের। এখনকার তরুণ সাকিব, তামিম, জয়, আকবর আলী, শরিফুল, রাকিবুলরাই তখনও আলো দেখাবে এই প্রত্যাশা করি।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক।