মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তখন টস করে, লটারি করে, র্যাফল ড্র করে। মানে হলো নিজেকে ভাগ্যের হাতে সপে দেয়। ছেলেবেলায় স্কুলে পড়ার সময় বিতর্ক করতাম। তখন এটা ছিল উপস্থিত বক্তৃতার মত। মানে তাৎক্ষণিকভাবে টস করে বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ করা হতো। ধরুন, বিষয়: বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? টস করে ঠিক করা হলো, কোন দল পক্ষে বলবে, কোন দল বিপক্ষে। হতে পারে আজ আপনি বিষয়ের পক্ষে বলছেন, কালই হয়তো একই বিষয়ে টসে আপনি বিপক্ষে বলার সুযোগ পেলেন। ভালো বিতর্কের মজাটা হলো, যুক্তি-তর্কের লড়াইয়ে দুই পক্ষকেই সঠিক মনে হয়। এই যে দুই পক্ষকেই সঠিক মনে হওয়ার বিভ্রম, এটা তো বাস্তবে সম্ভব নয়। ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক বেছে নিতে পারাটাই মানুষের বিবেক, বিবেচনা।
টিভি টক শো’তেও মাঝে মধ্যে সেই ছেলেবেলার উপস্থিত বক্তৃতার মত অবস্থা হয়। পছন্দমত আলোচক না পেলে বিপাকে পড়েন উপস্থাপক। তখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে কখনো কখনো অতিথিদের কাউকে কাউকে বলতে হয়, বিএনপির ভালো গেস্ট পাইনি, আজ একটু বিএনপির পক্ষে বলে দিয়েন। অনেকে সে অনুরোধ রাখেনও।
খেলায় যেমন টস হয়, উপস্থিত বক্তৃতায় যেমন টস হয়; তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা টস করি। এর একটি মজার খেলা আছে। ছড়ায় ছড়ায় আমরা টস করি- অবু দশ, বিশ…। যেখানে গিয়ে আঙ্গুল একশ’তে পড়বে, সেটাই সিদ্ধান্ত। আবার এমনও বলা হয়, রং ডিসিশন ইজ বেটার দ্যান ইনডিসিশন- সিদ্ধান্তহীনতার চেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ভালো।
সিদ্ধান্ত আর সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে এত কথা বিএনপির সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে। র্সবশেষটি নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। কারাবন্দী বিএনপি চেয়াপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করেছেন। তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতেও অনুরোধ করেছেন। ওবায়দুল কাদের তার অনুরোধ রেখেছেনও। দুর্নীতির দু’টি মামলায় ১৭ বছরের দণ্ড নিয়ে দুই বছরেরও বেশি সময় কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। দলের চেয়ারপারসনকে কারামুক্ত করতে যেমন ডেসপারেট চেষ্টা থাকার কথা, বিএনপির মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। খালেদা জিয়াকে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করা সম্ভব নয়, সেটি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছেন এবং স্বীকারও করেছেন বিএনপির আইনজীবীরা।
রাজপথে তাকে মুক্ত করার মত আন্দোলন করার সক্ষমতা বিএনপির নেই, সেটাও তারা বারবার প্রমাণ করেছেন। বাকি ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা ভিক্ষা বা স্বাস্থ্যগত কারণে প্যারোল। এ দু’টির জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা। কারণ রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা চাইতে হলে অপরাধ স্বীকার করে নিতে হবে। আর রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই কেবল এই মার্জনা পাওয়া সম্ভব। আর প্যারোল চাইলেও সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি এতদিন সমঝোতার কোনো চেষ্টাই করেনি। পারবেন না জেনেও তারা বারবার বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন, নইলে রাজপথে তীব্র আন্দোলন করে।
এতদিন তারা বলে আসছিলেন, আপসহীন নেত্রী কখনোই আপস করবেন না। কিন্তু দুই বছর পর এসে তারা বুঝলেন, রাজনৈতিক সমঝোতাতেই সমাধান। মির্জা ফখরুলের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। কারণ আমি মনে করি, যে কোনো মূল্যে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাটাই বিএনপির রাজনীতির এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিত ছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান যখন সাজা মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন, তখন খালেদা জিয়ার মুক্ত থাকাটা বিএনপির জন্য অতি জরুরি। কিন্তু অতি জরুরি বিষয়টা বুঝতে বিএনপির দুই বছর লাগলো কেন, এটাই বিস্ময়ের। অথচ সুযোগ ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা সংসদে যোগদানের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে দর কষাকষি করা। তখন তাদের হাতে খেলার কার্ড ছিল। আর এখন তাদের খেলতে হবে ব্লাইন্ডে। এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সরকারের বিশেষ করে সরকার প্রধানের সদয় দৃষ্টির ওপর নির্ভর করছে। তবে ফোনে বা মুখে অনুরোধ করলে হবে না; সেটার জন্য আবেদন করতে হবে, প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সেটা যত তাড়াতাড়ি করবেন, ততই মঙ্গল।
মজাটা হলো, বিতর্কের মত মনে হচ্ছে, বিএনপির দু’টি সিদ্ধান্তই সঠিক। আপসহীন নেত্রী কেন সরকারের করুণায় মুক্তি পাবেন? আবার ৭৫ বছর বয়সী অসুস্থ খালেদা জিয়ার মুক্তির চেয়ে বড় যুক্তি আর কী হতে পারে।
গত সপ্তাহে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি আগামী সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সামনেই গাইবান্ধা-৩, বাগেরহাট-৪, ঢাকা-১০, যশোর-৬, বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই ছয়টি নির্বাচনকে সামনে রেখেই বিএনপির এ সিদ্ধান্ত। তবে সিদ্ধান্তটি শুধু এ ছয়টি নির্বাচনের জন্য নয়, এরপর থেকে সব নির্বাচনেই বিএনপি অংশ নেবে। আমি এ সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানাই। কারণ আমি বরাবরই বলে এসেছি, হারজিত যাই হোক, বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। কারণ বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। বিএনপি নেতারা এখন বলছেন, ভোট বর্জন করে ঘরে বসে থাকার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই। বরং ভোটের মাঠে থাকলেই তাদের লাভ। বিএনপি এখন বুঝতে পারছে, ভোটের মাঠে থাকলে ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপির বিষয়টি আরো উন্মোচিত হবে। তারা আর কোনো নির্বাচনই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার ধারণা, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে হারলেও মাঠে থাকার সুবিধাটা তারা বুঝতে পেরেছেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুবাদে অনেকদিন পর বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে মাঠে থাকতে পেরেছেন, মিছিল-সমাবেশ-প্রচারণায় অংশ নিতে পেরেছেন। এই দুই নির্বাচন ঢাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে দারুণ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। বিলম্বে হলেও সেই লাভটা তারা বুঝতে পেরেছেন, এটাই মঙ্গল।
অথচ এই ভালোটা তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে বুঝতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিপুল জয় পেলেও সেই ধারাবাহিকতা তারা জাতীয় নির্বাচনে টেনে নিতে পারেননি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির দোদুল্যমানতা স্পষ্ট ছিল। কখনো তারা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেন, কখনো নেন না। একবার বলেন, এই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের বৈধতা দেওয়া অর্থহীন। কিন্তু নির্বাচন ঠেকানোর সামর্থ্যও তারা হারিয়েছেন অরেক আগেই। তাই বিএনপি অংশ না নিলেও সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি তারা জোরেশোরে তুলতে পারেননি। বরং নির্বাচন বর্জন করে তারা রাজনীতিতে আরো অপাংক্তেয় করে তোলেন নিজেদের।
২০১৪ সালের পরিস্থিতি আর ২০১৮ সালের পরিস্থিতি একই ছিল। একই সরকার, সেই সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন; তারপরও তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যতটা পিছিয়েছে, ২০১৮ সালে অংশ নিয়েও তা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
বিএনপির মত দলকে মাত্র ছয়টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এখন যদি বিএনপির কোনো কর্মী প্রশ্ন করেন, পরিস্থিতি না বদলালেও কেন আগে আপনারা নির্বাচনে যাননি, কেন এখন যাচ্ছেন; কী জবাব দেবেন স্থায়ী কমিটির নেতারা?
বরং ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং পরের বছর নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে আন্দোলনের নামে তারা যে জ্বালাও পোড়াও করেছেন, তা একটি নিয়তমান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভাবমূর্তিকে আরো প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। দেরিতে হলেও তারা নিজেদের ভালোটা বুঝতে পেরেছেন, এটা সবার জন্যই মঙ্গল।
সিদ্ধান্তহীনতা শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে নয়, সংসদে যোগ দেওয়ার প্রশ্নেও দেখা গেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পাওয়ার পর তারা সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন বলা হচ্ছিল, সংসদে যোগ দিয়ে এই অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে মুখে অনেক কথা বললেও কার্যত তারা মাঠে বা আদালতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিবাদ করেতে পারেননি। তখন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। এমনকি একজন সদস্য দলের সিদ্ধান্ত অসম্মান করে সংসদে যোগ দেওয়ায় তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে। দলে তাকে সবাই বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সংসদে যোগ দেওয়ার শেষ দিনে নেতাকর্মীদের অন্ধকারে রেখে বিএনপির এমপিরা সুরসুর করে সংসদে চলে গেলেন। এতদিন যারা বলছিলেন, সংসদে যোগ দিয়ে এই সরকারকে বৈধতা দেওয়ার কোনো মানে হয় না; তারাই বলতে থাকলেন আন্দোলনের অংশ হিসেবেই সংসদে যোগ দিচ্ছেন তারা। এখন সংসদের ভেতরে-বাইরে সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে। সরকারকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়া হবে না। খুব ভালো সিদ্ধান্ত। আমরাও চাইছিলাম বিএনপি সংসদে যাক। কিন্তু সেটা এত দেরিতে এবং এমন লুকোচরি করে কেন? তারওপর সবাই সংসদে গেলেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল গেলেন না। সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন গড়াটাই যদি সঠিক সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে মির্জা ফখরুল গেলেন না কেন? এই প্রশ্নের কোনো যৌক্তিক উত্তর আজও মেলেনি। বিএনপির এই সিদ্ধান্তহীনতায় বিপাকে পড়েন দলের নেতাকর্মীরা। সকালেও বিএনপির যেসব নেতাকর্মী সংসদে না যাওয়ার পক্ষে তুমুল তর্ক করেছেন, বিকেলেই তাদের যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে হয়। সেই ছেলেবেলার উপস্থিত বক্তৃতার মত।
রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে, কৌশল বদলাতে পারে। তবে পরিস্থিতি না বদলালেও বিএনপির নেতারা যখন একবার এই পক্ষে যুক্তি দেন, আরেকবার ওই পক্ষে; তখন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হন। রাজনীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে অনেক সময় রাজনৈতিক দল কোণঠাসা হয়ে যায়। এটা ঠিক, সরকারি দল প্রবল চাপ সৃষ্টি করে বিএনপিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তবে নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত তাদের সেই দুর্দশাকে আরো প্রকট এবং প্রলম্বিত করেছে। আশা করি, সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপি অনড় থাকবে এবং নেতাকর্মীদের মাঠে ব্যস্ত রাখবে। আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত যেন তাদের আরো বেশি বিপদে না ফেলে। মাঠে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাটা সরকারের জন্য, দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, এমনকি সরকারি দলের জন্যও বিপদজনক।
প্রভাষ আমিন: হেড অফ নিউজ, এটিএন নিউজ