বইমেলায় গুচ্ছ গুচ্ছ আড্ডা জমে ওঠার মতো করে সাজানো। স্টল, প্যাভিলিয়ন ঘুরে দেখার মতো এমন আড্ডাও বেশ আকর্ষণীয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল, প্যাভিলিয়নের চেয়ে আড্ডা ঘুরে দেখা হয়েছে বেশি। খুব কম আড্ডার বিষয় ছিল সাহিত্য বা বইয়ের বিষয়। রাজনীতিকেও আড্ডার বিষয় হিসেবে পাইনি। যদি পেতাম প্রেম, তাহলেও বলা যেত বইয়ের স্পর্শে এসে বই’র উদ্যানে বসে অধরা প্রেমকে নিয়ে বা ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কিছু আর্দ্র শব্দ বা বাক্য শুনতে পেয়েছি। না তেমন কিছু শব্দ কানে এসে পৌঁছেনি। আড্ডাতে উচ্চারণও কম ছিল। সবাই নিজস্বী, বহুস্বী তোলাতেই ব্যস্ত। মনের ভাব প্রকাশের তাড়না কমই দেখতে পেলাম। তাদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টের খাওয়া দাওয়া। মোটর বাইকে ঘুড়ে বেড়ানো। চাকরির ইন্টারভিউ। বিসিএস পরীক্ষা। ওয়াজ বা ফেসবুক, ইউটিউবে ভেসে বেড়ানো কিছু চলতি বিষয়। আড্ডার মানুষদের হাতে বই ছিল না, এমন বলবো না। ছিল, তবে তিনি বা তারা কেন ঐ বই কিনেছেন, তার উদ্দেশ্য বিধেয় তাদের জানা নেই।
প্রতি বইমেলার মতো এবারও স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মেলা ঘুরে বেড়িয়েছে প্রায় প্রতিদিনই। ওদের দেখে মন জুড়িয়ে গেছে। বইয়ের উদ্যান তো ওদের অপেক্ষাতেই। কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই যেন এসেছিল দর্শনীয় কোনো স্থানে পর্যটক হিসেবে। ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা, খাওয়া দাওয়াতেই সফর শেষ। বই আর স্পর্শ করা হলো না। বই কিনেনি কেউ এমন করে তো বলা যাবে না। তবে শিক্ষার্থীরা যেন পাঠের একটি নির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের আগ্রহে নতুন নতুন বিষয় হয়তো যোগ হচ্ছে, কিন্তু সেখানে সাহিত্য নেই। কেবলই তথ্য। পাঠ্যক্রমের বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বই খুঁজছিল তারা। স্কুল, কলেজ না পেরোতেই সহজে চাকরি পাওয়া যাবে, জীবনে ভোগ-উপভোগ সহজ হবে এমন বই তাদের হাতে দেখেছি। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই।
আমাদের সন্তানরা কি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত? না হলে তাদের হাতে হতাশা থেকে ভেসে ওঠার বই কেন? পড়ুক। ওরা সকল ধরনের বই পড়ুক। কিন্তু তাই বলে সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাবে। ওদের কি আমরা জানাতে পারিনি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের কথা, তারাশঙ্করের কবি, বিভূতিভূষণের শঙ্কর, আন্না কারেনিনা, দ্যা অ্যালক্যামিস্টের সান্তিয়াগোর সঙ্গে। কিংবা ইস্পাতের পাভেল করগাচিনের সঙ্গে ওদের দেখা করিয়ে দিতে পারিনি। সাহিত্যের এই নায়কদের চেয়ে আর কে তরুণ মনে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পেরেছে?
প্রযুক্তি কিশোর তরুণদের বই বিমুখ করেছে কথাটি মিথ্যে নয়। এই সত্য জানার জন্য কারো ঘরে উকিঁ দেবার প্রয়োজন নেই। রেস্টুরেন্ট, বিনোদন কেন্দ্র, হাসপাতালের বর্হিবিভাগ, লঞ্চ, ট্রেন, বিমানবন্দরে শিশু, কিশোরদের খেয়াল করে দেখুন, দেখবেন ওদের হাতে মোবাইলফোন-ট্যাব। ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কোনো বিস্ময় নেই। আছে ক্রোধ। কারণ ওরা ইউটিউবে হয়তো কোনো মোটরবাইক, গাড়ির দৌঁড়ে আছে। সেখানে নিজের পছন্দের বাইক, গাড়িটিকে জেতাতে হবে। কোনো খেলায় বুঁদ হয়ে থাকলে সেখানে হারা চলবে না। জিততেই হবে। ক্রোধ ও প্রতিহিংসা শিশু-কিশোরদের অবয়ব থেকে নির্মল হাসি কেড়ে নিয়েছে। তাদের হাতে ঐ যন্ত্রগুলো তুলে দিচ্ছেন বাবা-মায়েরাই। তারা নির্বোধের মতো ভাবছেন- তাদের সন্তানরা শিশুকালেই কেমন প্রযুক্তি বান্ধব হয়ে গেছে। তাদের দামি চাকরি, স্বপ্নের দেশে উড়াল দেয়া কতো সহজ হয়ে যাচ্ছে। আসলে তারা শিশুদের এক প্রকার মাদকের আসক্তির দিকেই ঠেলে দিয়েছেন।
শিশু-কিশোর মনে জন্ম নেয়া এই প্রতিহিংসার বহি:প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি কিশোর গ্যাং এবং কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ার হার দেখে।
বইমেলার শিশুচত্বরেই অনেক বাবা মা’কে বলতে শুনলাম- তাদের ছেলে মেয়েদের এখন আর বই কিনে দিতে হয় না। তারা অ্যাপস থেকে বই নামিয়ে নেয়। বাংলা পড়তে চায় না। ভালো লাগে না। বাংলায় আর ভাল বই কই? তাই ইংরেজি বই নামিয়ে পড়ে। পড়ুক না। যে কোনো ভাষার বই পড়ুক। কিন্তু তাই বলে বাংলা বই পড়বে না? আফসোস হয় ঐ সন্তানদের জন্য, নিজের মায়ের ভাষা পড়তে না জানলে, এই দেশকে, এই দেশের প্রকৃতি, গৌরবময় ইতিহাসের কথা জানবে কী করে ওরা? নিজেকে না জেনে অন্যকে জানায় জ্ঞান কি পূর্ণতা পায়? নিজেকে না জানলে যে অন্যকেও জানা হয় না। জানা শেখা যায় না। এই সত্য কি করে বোঝাই ওদের বাবা মা কে? আর কাগজের বই স্পর্শ না করলে যে হৃদয় ছোঁয়া যায় না। এই সত্যও তো ওদের জানাতে হবে। তার আগে ওদের বাবা-মা, অভিভাবকদের সেই জানার সীমানায় আনা জরুরি।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন