ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা অব্দি অফিস করে গেলাম বইমেলায়। সঙ্গে টেলিভিশনের এক প্রডিউসার। তখনও মেলা জমেনি। দুপুরে লোকজন কমই আসেন। আস্তে আস্তে সূর্য হেলতে হেলতে পাঠক-দর্শকের পদচারণায় মুখোর হলো মেলা প্রাঙ্গন। তার আগে ঠিক বিকেলের সময়টায় কথা হচ্ছিল এক পাঠকের সঙ্গে। ২১শে ফেব্রুয়ারির আগের কথা বলছি। তিনি সিরিয়াস পাঠক। নিয়মিত বই কেনেন। তার বিভিন্ন প্রসঙ্গের মধ্যে একটা ছিল, মোটিভেশনাল বইগুলো এই বাজারে আসছে কেন? এটি রোধ করার উপায় কী? সাহিত্যের বইমেলা কি এখন সস্তা উপদেশ বাণীর মেলা হয়ে উঠেছে?
তাকে উত্তর দিলাম, ভাই দেখুন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন ধরে খুব আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আশা করি আগামীবার থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার মেলা অনেক সুন্দর দেখতে, স্থাপত্যে। আগামী বছর লেখার মানের দিক দিয়েও সুন্দর হবে সে আশা করি।
এর বেশি আর কী-ই বা বলবো তাকে! আমি তো শুধু মোটিভেশনাল বই দেখি না, দেখি ইউটিউবারদের অখাদ্যের বইও। যার নেই সাহিত্য মান। কোনো কোনোটি আবার বাংলা, ইংরেজি, রোমানসহ একত্রে আরও কত না হরফে লেখা! পাঁচ মিশালি মাছ পচলে যেমন গন্ধ ছড়ায় নাকে তেমন বাজে গন্ধ পাই সেসবের কাছে ঘেঁষলে! কেন না বাজে বাজে উক্তি বা শব্দে ভরা ওসব গন্ধ পচা বই। এই যদি হয় সাহিত্যের অবস্থা তাহলে আগামী কয়েক বছরে, নতুন প্রজন্মের কাছে সাহিত্যের সংজ্ঞাই বদলে যাবে। তারা মনে করবে সৃজনশীলতাহীন উদ্ভট ভাষা মিশ্রিত বই-ই সাহিত্য। তখন আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, আসাদ চৌধুরী কিংবা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বদলে গণহারে হাতে তুলে নেবে পছন্দের ইউটিউবারের মানহীন বই। নজরুল বা রবীন্দ্র পাঠক লোক হবেন আমাবস্যার চাঁদ! কারণ এমনতিই মানুষ এখন পড়ার চেয়ে দেখতে বেশি অভ্যস্ত। যুগটাই যে ভিজ্যুয়ালাইজেশনের। সিরিয়াস বিষয়েও পাঠকের আগ্রহ কম। ইউটিউবের তথাকথিত তারকাকে বহু দেখেছেন, নিজের প্রিয় ডিভাইসে। তাই হুমড়ি খেয়ে তার বই কেনার জন্যই ছুটে যাচ্ছেন লোকজন। দেখছেন না সাহিত্য মান, না দেখছেন ভাষার গঠন। সাময়িক বিনোদনের জন্য কিনছেন বই। এতে বই আর চিরদিনের বন্ধু হিসেবে থাকতে পারছে কই!
সৃজনশীলতা না থাকা এসব বস্তাপচা বইগুলোর মানহীনতার বিষয়টি সিরিয়াস পাঠকদের কাছে খারাপ লাগছে। মেলা যেখানে মজার সাহিত্য নিয়ে আড্ডার স্থলও হওয়ার কথা সেখানে মেলায় সহ্য করতে হচ্ছে লেখা নয়- এমন লেখাকেও। এতে বাড়ছে ক্ষোভ। এ প্রসঙ্গে মতামত নিতে কথা বলবো এক প্রকাশকের সঙ্গে। তাই গেলাম। শোভা প্রকাশের মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে সালাম দিতেই বললেন, মানহীন বই নিয়ে বিরক্ত তিনি। ঠিক যে প্রশ্ন আমি করতাম, তিনি সেটারই উত্তর দিলেন নিজে থেকে। বললেন, কিছু প্রকাশক সাহিত্যের মান বজায় রেখে বই বের করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কষ্ট লাগে তখনই যখন অনেক প্রকাশক এই সাহিত্য মানের সঙ্গে করেন আপস। তারা বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ভালো সাহিত্যকে পাশ কাটিয়ে যান। একই সঙ্গে বের করেন বিভিন্ন রকম মোটিভেশনাল বই। ফেসবুকের স্ট্যাটাস সমগ্র। এই বইগুলো আবার বেস্ট সেলারও হয়! মানুষের হতাশাকে পুঁজি করে ব্যবসা করাটা অনুচিত, বিশেষ করে বইমেলায় এটা একেবারেই বেমানান, অশোভন। সস্তা মোটিভেশনাল বইয়ের কারণে কমছে খাঁটি সাহিত্যের বইয়ের কদর। কমছে বিক্রি। সার্বিকভাবে যা সাহিত্যের বাজারে প্রভাব ফেলছে। নতুন লেখকের বই মার খেয়ে যাচ্ছে। এমনকি পরিচিত, ভালো লেখকরাও কাটতি হারাচ্ছেন। যা সত্যিই দুঃখের।
এছাড়া সাহিত্যের নানা মাত্রা থাকলেও, প্রতিযোগিতার বাজার ধরতে গিয়ে গুটি কয়েক মাধ্যমেরই বই বেশি প্রকাশ হচ্ছে। বৈচিত্র্যময় বই প্রকাশিত হচ্ছে না। ইতিহাস-ঐতিহ্য, গবেষণা, সাংবাদিকতা, প্রবন্ধ, কলামের বইয়ের বাজার আরও সংকুচিত হচ্ছে। এতে ভালো পাঠক তৈরি হচ্ছে না। আমাদের এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সাহিত্যের মেলা যেন সাহিত্যেরই থাকে- এ বিষয়টায় জোর দেয়ার সময় এসেছে। সাহিত্য মানে শুধু ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস নয়- মৌলিক সৃজনশীল বই চাই। বাংলা একাডেমিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির কাজের জায়গা রয়েছে এখানে।
তার কথার সঙ্গে পুরোপুরি একমত। ঠিক যেভাবে ভাবছিলাম সেভাবেই বললেন তিনি। কথাগুলো নিজের মতো করেই বলতে পারতাম, কিন্তু একজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মুখে শুনলে বিশ্বাসযোগ্য বেশি হবে সন্দেহ নেই। বাংলা একাডেমি বলছে, দাবি করছে, বইয়ের মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্বটা আসলে কার? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যেসব বই নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলো কেন এখনও বাজারে (মেলার স্টলে বা অনলাইনে) দিব্যি পাওয়া যাচ্ছে? বইতে ধর্মীয় উস্কানির কিছু থাকলে টাস্কফোর্স যেভাবে ব্যবস্থা নেয় সেভাবে কেন মানহীন বইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গঠিত টাস্কফোর্সের সঙ্গে বাংলা একাডেমির লোকবলও কাজ করেন, তারা চাইলেই বিতর্কিত বই যাচাই করে নিষিদ্ধ করতে পারেন। প্রকাশককে সতর্ক করার পাশাপাশি হতে পারে জরিমানাও।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী নিজে এ বিষয়ে একাধিকবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আগামীবার থেকে মানহীন বই ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বইয়ের মানদণ্ড নির্ধারণে নীতিমালা করার সুরও ছিল তার কণ্ঠে। এটা যেন কথার কথা না হয়ে থাকে। ২০২১ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আগে বইয়ের মানদণ্ড নির্ধারণে একটি নীতিমালা যেন প্রণয়ন করা যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে প্রকাশকদেরই। অন্তত নিজেদের ভালোর জন্য। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিরই এটা দায়িত্ব। এতে করে মেলার অনেক ঘাটতি পূরণ হবে। ২০২১ থেকে ভালো বই আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব নিতে হবে।
মেলা শেষে তথ্যকেন্দ্রের তালিকার সঙ্গে প্রত্যেক প্রকাশনীর নতুন বইয়ের তালিকা (ক্যাটালগ) মিলিয়ে দেখা খুব জরুরি। যেসব বই তথ্যকেন্দ্রে জমা দেয়া হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে হতাশার ব্যাপার হলো, পাইরেটেড, লেখা চুরি, ভুলে ভরা ও নিম্নমানের বই ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অনেক পরিচিত মুখকে দেখা যায় তদবির করতে। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির কঠোর মনোভাবই পারে নতুন কিছু করতে। এটা সাহিত্যের বইয়ের এবং বইপ্রেমীদের মেলা। বাংলা ভাষার মেলা, অমর একুশের মেলা। ভাষা শহীদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মেলা। এটা পাক্কা ব্যবসায়ীদের মেলা নয়, মেলা নয় ভুলে ভরা ভাষায় লেখা লেখকদের। এ মেলায় কখনোই বাণিজ্যিক মনোভাব ছিল না। যারা ভালো বই নিয়ে আসবেন, বইয়ের সংখ্যা কম হলেও তাদের সুযোগ দেয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখকদের উচিত লেখতে পারলেই বই প্রকাশের জন্য হুমড়ি খেয়ে না পড়া। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করে নিজেকে পরিচিত করা জরুরি। যে লেখা পত্রিকা বা মূল ধারার অনলানে ছাপার যোগ্য না তা কী করে বই আকারে বের হয়! বই বের করতে হবে বলে একটা বানিয়ে-গুছিয়ে লেখে খেললাম, তো সর্বনাশ করলাম সাহিত্যের। এসব লেখা নিয়ে বই হলে বইয়ের মান পড়তে আর কিছু লাগে না।
পাশাপাশি পাঠকদেরও বুঝতে হবে এ মেলা প্রাণের। এটাকে অনেকেই সেলফি জোন হিসেবে পরিণত করেছেন। যা দোষের কিছু নয়, কিন্তু বইয়ের প্রতি অনুরাগ কমছে বলে দুঃখ লাগে। যে পরিমাণ মানুষ মেলায় আসেন, সে পরিমাণ বিক্রি হয় না বই। আগামীবার মেলা যেন হয় স্রেফ সাহিত্যের, পাঠকরাও ভালো সাহিত্যের কদর দেবেন, পোড় খাওয়া লেখকদের সম্মান করবেন বই কিনে এই আহ্বান জানাবো। কারণ ভাষার প্রতি সাধারণ মানুষ হিসেবে দায়িত্ব কিন্তু আপনারও আছে। না হলে মানের দিক দিয়ে বইমেলা আর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পার্থক্য রবে না একটুও।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক