থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-28 05:10:32

মাশরাফি ঘোষণা না দিলেও আমরা সবাই জানতাম জিম্বাবুয়ে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটি অধিনায়ক হিসেবে তার শেষ। মাশরাফি আসলে সারপ্রাইজ দেয়ার সুযোগ পাননি। জিম্বাবুয়ে সিরিজ শুরুর আগে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন নিজেই অধিনায়ক মাশরাফির বিদায় ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। শেষ ম্যাচের আগে মাশরাফি নিছক আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন। তবে অধিনায়ক হিসেবে ইতি টানলেও খেলা থেকে অবসর নেননি তিনি।

যত ভালোই হোক, সব ভালোরই শেষ আছে। মাশরাফিকেও যেতেই হবে। কিন্তু একটা খটকা আমার কিছুতেই যাচ্ছে না। মাশরাফি অধিনায়ক হিসেবে অবসর নিলেও খেলা চালিয়ে যেতে চান। এখন নির্বাচকরা তাকে সাধারণ একজন খেলোয়াড় হিসেবেই বিবেচনা করবেন। যদি তিনি সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলে সুযোগ পান, তাহলে খেলবেন। তবে মুশফিকুর রহিমের ধারণা মাশরাফির যা পারফরম্যান্স, তাতে আরো অন্তত দুই বছর খেলা চালিয়ে যেতে পারবেন। আমার কথা হলো, মাশরাফি যদি আরো দুই বছর খেলোয়াড় হিসেবে দলে থাকতে পারেন, তাহলে অধিনায়ক হিসেবে নয় কেন? আমি তো বরং একটা অবাস্তব কথা ভাবছিলাম, নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হিসেবে হলেও কোনো না কোনোভাবে যেন মাশরাফিকে দলের সঙ্গে রাখা হয়। দলের সঙ্গে মাশরাফির থাকাটাই একটা দারুণ ব্যাপার।

পরিসংখ্যানের হিসেবেও মাশরাফি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সাফল্যের পরিসংখ্যানে তাকে ছাড়িয়ে যাবেন। তারপরও অধিনায়ক মাশরাফিকে ছাড়িয়ে যাওয়া যে কারো পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও। আমি অন্তত মাশরাফিকে কখনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপি না। আমার বিবেচনায় মাশরাফি শুধু বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক নন, বিশ্বের সেরা অধিনায়কদের তালিকা করলেও তা থেকে তাকে বাইরে রাখা যাবে না। মাশরাফি আসলে অতুলনীয় এবং যুগস্রষ্টা। এই কথাটা মোটেই আবেগের নয়। অতুলনীয় বলছি, কারণ মাশরাফি বারবার ধ্বংস্তূপ থেকে উঠে এসেছেন ফিনিক্স পাখির মত। অনেকবারই অনেকে তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। দুই হাঁটুতে সাতটি অপারেশন নিয়ে যেখানে কারো পক্ষে খেলাই সম্ভব নয়, সেখানে মাশরাফি নিজেকে তো বটেই, বদলে দিয়েছেন পুরো একটা দলকে।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেকগুলো টার্নিং পয়েন্ট আছে। সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্টটি নিঃসন্দেহে মাশরাফির অধিনায়কত্বের চূড়ান্ত পর্যায়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বিবেচনা করা হবে দুই ভাগে-মাশরাফি পূর্ব, মাশরাফি পরবর্তী। মাশরাফি সেরা, তবে তাই বলে আগের অধিনায়কদের খাটো করছি না। এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা হর হামেশাই সেঞ্চুরি করেন। টেস্ট ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরিও আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই ১৯৯৭ সালের আইসিসিতে হল্যান্ডের বিপক্ষে আকরাম খানের ৬৮ রানের ইনিংসটির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। সেবার আইসিসিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদেই বাংলাদেশ সুযোগ পেয়েছিল ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ খেলার। সেবার পাকিস্তানকে হারিযে দিয়েই বাংলাদেশ নজর কেড়েছিল বিশ্বের। তাতেই পরের বছর টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল বাংলাদেশ। অভিষেক টেস্টে ভারতের বিপক্ষে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সেঞ্চুরি আমাদের মাথা উঁচুই রেখেছিল। তাই প্রত্যেকটি পর্যায়ে ব্যক্তিগত অবদান একেকটি মাইলফলক।

তবে মাশরাফি আসলেই বদলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। মাশরাফি নেতৃত্ব দেয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ মাঠে নামতো সম্মানজনক পরাজয় নিশ্চিত করতে। মাশরাফি এসেই দলের মনোভাবই বদলে দিলেন। এরপর থেকে প্রতিপক্ষ যেই হোক, লড়াকু মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ মাঠে নামতো জয়ের জন্য। যেমন পাকিস্তানকে বদলে দিয়েছিলেন ইমরান খান, ভারতকে সৌরভ গাঙ্গুলী; তেমনি বাংলাদেশকে মাশরাফি।

মাশরাফির অধিনায়কত্বেরও আবার অনেকগুলো ধাপ আছে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে প্রথম নেতৃত্ব পান মাশরাফি। কিন্তু প্রথম সিরিজেই চোট পেয়ে চলে যান মাঠের বাইরে। সেই চোট তার নেতৃত্ব তো কেড়ে নেয়ই, কেড়ে নেয় টেস্ট খেলার আকাঙ্ক্ষাও। আবার নেতৃত্বে ফেরেন ২০১০ সালের ইংল্যান্ড সফরে। কিন্তু সাত ম্যাচ খেলেই আবার চোট। অনেকেই তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাশরাফি অধ্যায়ের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। এখানেই মাশরাফি অনন্য এবং অতুলনীয়।

২০১৪ সালে চোট জর্জরিত হাঁটু নিয়ে আবার ফিরে এলেন এবং ফিরলেন অন্য মাশরাফি হয়ে। যার ফুরিয়ে যাওয়ার কথা, তিনি হয়ে গেলেন সেরা অধিনায়ক। ডাক্তারের কথা শুনলে এবং নিজেকে ভালোবাসলে মাশরাফির মাঠেই নামার কথা নয়। ডাক্তার এমন কথাও বলেছেন, এ অবস্থায় খেলা চালিয়ে গেলে ৪০-৪৫ বছর বয়সে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে হবে। কিন্তু কিছুই আটকাতে পারেনি তাকে।

তৃতীয় পর্যায়ের অধিনায়কত্বে মাশরাফির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। না, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়নি, কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। তবে সেবারের বিশ্বকাপে সত্যিকারের চমক ছিল বাংলাদেশ। পুতু পুতু স্পিন নয়, গতির ঝড়ে বাংলাদেশ কাঁপন ধরিয়েছিল প্রতিপক্ষের ব্যাটিং অর্ডারে। এই যে সাহস, এটাই মাশরাফির অবদান। বিশ্বকাপে মাশরাফির নেতৃত্বে যে জয়রথে চেপে বসেছিল বাংলাদেশ, গতিজড়তায় তা মাড়িয়ে দেয় ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়েকে। ভারতের বিপক্ষে পাঁচ পেসার নিয়ে খেলতে নেমে মাশরাফি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দিন বদলে গেছে।

মাশরাফি এসেছিলেন গতির ঝড় তুলে। সবাই ডাকতেন নড়াইল এক্সপ্রেস। কিন্তু ইনজুরির কারণে আস্তে আস্তে গতি কমে যায়। শুরুতে অলরাউন্ডার থাকলেও পরে আর ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে পারেননি। কিন্তু তার আসল কৃতিত্ব তার সাহসে, নিবেদনে। দুই হাঁটুতে সাতটি অপারেশন নিয়েও ফিল্ডিংয়ে যে ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন, তা অবিশ্বাস্য। এমনকি অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচেও একাধিকবার তিনি ঝাঁপ দিয়েছেন। যারা জানেন, তারা বুঝবেন মাশরাফি আসলে নিজের চেয়েও দেশকে বেশি ভালোবাসেন।
তবে আগেই বলেছি, মাশরাফিকে আমি কখনো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপি না। পরিসংখ্যান দিয়ে মাপলে তার বড়ত্বটা ঠিক বোঝা যাবে না। মাশরাফি হলেন একজন সহজাত নেতা। বুক ভরা সাহস আর দেশপ্রেম। পুরো দলকে আগলে রেখেছেন দারুণ মমতায়। মাশরাফির বিদায়ের দিনে তামিম ইকবাল বলেছেন, সবাই যখন তাকে বাদ দেয়া নিয়ে কথা বলছিল, তখনও মাশরাফি তার পাশে ছিলেন। শুধু তামিম নয়, যে কারো বিপদের দিনে আর কেউ পাশে থাকুক আর না থাকুক, মাশরাফি অবশ্যই তার পাশে থেকেছেন। এটাই একজন নেতার গুণ। সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রাখা, আত্মবিশ্বাসে চাঙা রাখা। তরুণ কারো মধ্যে সামান্য সম্ভাবনা দেখলেও মাশরাফি তাকে সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটা পরিবারে পরিণত হয়েছিল।

সেই পরিবারের দায়িত্ব এখন তামিম ইকবালের কাঁধে। কাঁধটা যে যথেষ্ট চওড়া এবং শক্তপোক্ত, মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচের পর সেটা প্রমাণও করেছেন তামিম। বিপদের বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকেই মাশরাফিকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তামিম। শুধু তামিমের কাঁধে চড়েই শেষ হয়নি মাশরাফির বিদায়পর্ব। মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচের পর হঠাৎ গায়েব বাংলাদেশ দল। একটু পর দেখা গেল মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক মাশরাফি। স্কোয়াডের সবার পড়নে একই রকম জার্সি। সবার জার্সির পেছনেই ইংরেজিতে লেখা- মাশরাফি, সবার জার্সি নম্বর ২। আর সামনে লেখা থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন। সিলেটের মাঠে সেদিনের দর্শকরাও তাদের সঙ্গে গলা মেলান- থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন। মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে যা দিয়েছেন, তাতে এটুকু ভালোবাসা তার জন্য বরং কম হয়ে যায়।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর