উদাসীনতা নয়, আসুন সচেতন হই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

সৈয়দ ইফতেখার | 2023-08-23 22:02:04

করোনা কোয়ারেন্টাইনে! কথাটা এমন হলে কত না ভালো হতো! মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার পরিবর্তে কোয়ারেন্টাইনে রাখতাম খোদ কোভিড নাইনটিনকে! সবাই সচেতন হয়ে গেলে সেটাই হবে আগামীতে। এতো চিন্তার কিছু নেই। যে যার স্থান থেকে দায়িত্বটা পালন করে গেলে, কোনো সমস্যাই হতো না। এখনও যা হয়েছে (সমস্যা) সেটাকেও নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা কঠিন নয়। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে, এই প্রবাদের মতো দায়িত্বগুলো কার কার- সেটি আগে বুঝতে হবে। সে অনুযায়ী নিতে হবে পদক্ষেপ।

দায়িত্ব সরকার ও জনগণ- দুই পক্ষেরই। কিন্তু বিমানবন্দরগুলোতে দুর্বল নিরাপত্তা, দুর্বল স্বাস্থ্য পরীক্ষা ব্যবস্থার কারণে প্রশাসন কি তার দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পেরেছে? সে প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট করে না দিলেও চলবে। কারণ থার্মাল স্ক্যানার অচল, নষ্ট, পর্যাপ্ত নয় এই ধরনের সংবাদ রীতিমতো হয়েছে ভাইরাল। মানুষ জানে কী হয়েছে গেলো প্রায় একটি মাসে। পাশের দেশ চীন থেকে না এলেও, সুদূর ইতালি থেকে করোনা এসেছে দেশে! এ পর্যায়ে কী আর করার, এ সংখ্যা যত কম রাখা যায় সেদিকে জোর দেয়াই উত্তম।

খুব কম দেশই আছে যেখানে করোনা নেই। এটা এখন এক বৈশ্বিক সংকট। যার কারণে শুধু স্বাস্থ্যগত ক্ষতিই হচ্ছে না, হচ্ছে অর্থনীতি, শিক্ষা, ভ্রমণ-সফর সংশ্লিষ্ট লোকসানও। উন্নত দেশ ইতালিকে আমরা দেখছি হিমশিম খেতে। তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে তাদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে দিন দিন করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তারাও ভালো কাজ করছে। চীনে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা কী করছি? উড়োজাহাজসহ স্থলবন্দরগুলো দিয়ে বিদেশিরা বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই আসছেন। ঢুকে পড়ছেন দেশে অবাধে।

ক'দিন আগের একটা ঘটনা বলি। তখনো করোনা আসেনি দেশে। যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছি। যশোর বিমানবন্দর হয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর- কোথাও দেখিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা। যদিও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, তাই বলে কি পরীক্ষার ন্যূনতম ব্যবস্থা থাকবে না? নভেল করোনার যুগে অবাধে যে কেউ চলে আসতে পারবেন রাজধানী শহর ঢাকায়? বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজে ছিলেন অনেক বিদেশিও। আমরা জানি, করোনা প্রাথমিকভাবে সুপ্ত থাকে- ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এর লক্ষণ, তাই পরীক্ষা করা উচিত প্রতিনিয়ত। অথচ আমরা দিব্যি উদাস সময় পার করেছি। ঢিলেঢালা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

যশোরের বেনাপোল হয়ে প্রচুর ভিনদেশী বাংলাদেশে আসছেন রোজ। ঢাকায় আসতে তাদের অনেকে ব্যবহার করছেন এই অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরই। তাদের কেউ আক্রান্ত কিনা তা নির্ণয় করা কি উচিত নয়? তারা ঢাকায় অবাধে চলে আসছেন এটা কী করে হয়! কারো মধ্যে ভাইরাস থাকলে তা পুরো ঢাকাকে আক্রান্ত করবে না? যশোরে না হলে আপাতত ঢাকায় তো স্ক্যানারের ব্যবস্থা রাখা উচিত। সারাবিশ্বই যেখানে কতশত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সচেতনতা করেও করোনা ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমরা এতোটা উদাস হয়ে দিন পার করেছি কী করে!

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এক সপ্তাহে পরিস্থিতি বদলে গেছে তা নয়। আমাদের জন্যে হয়ত এটাই স্বাভাবিক! তা না হলে আন্তর্জাতিক রুটের টার্মিনালে ভাইরাস শনাক্তের জন্য বসানো তিনটি থার্মাল স্ক্যানারের দুটিই কীভাবে বিকল হয়ে পড়ে! সেক্ষত্রে অভ্যন্তরীণ রুটে জোর দেয়ার সময় কই! গ্রীষ্ম, বর্ষা না আসতেই (বসন্তেই) ডেঙ্গু রোগী ইতোমধ্যে দেশে শনাক্ত হয়েছেন। এখন কোভিড-নাইনটিনও যদি ছেয়ে যায় তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কী আর স্বাস্থ্যসেবার মানই বা কী তা নিয়ে জনমনের প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

তাই বলি কী, জনগণকে সচেতন হতে বলার আগে, নিজ উদ্যোগে আগে প্রশাসনের উচিত সচেতন হওয়া। করোনা যখন ঢুকেই পড়েছে তখন কেনো ওই দিনই তড়িৎ ব্যবস্থা নিয়ে অন্তত মাস্ক, হ্যান্ড-ওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি? মানুষ হুমড়ি খেয়ে কিনতে যাবে, কেউ কেউ দামও বাড়াবে এটা কেনো আগেভাবে অনুমান করা গেলো না? আর যেসব ব্যবসায়ী মাস্ক, হ্যান্ড-ওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম বাড়িয়েছেন তাদের অন্তত আগাম সতর্ক করা দরকার ছিল?

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ৯ই মার্চ জানালো, কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে এলেই করোনায় আক্রান্ত নন। পরদিন তারাই বললো, বিদেশ থেকে দেশে ফিরে ১৪ দিন সেলফ কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। আগে ঠিক করতে হবে সরকারকে যে সাবধানতা হিসেবে তারা কী কী করতে চান। নিত্য নতুন বক্তব্যের চেয়ে নিজেরা সচেতন হয়ে অন্যকে আতঙ্কমুক্ত করতে কাজ করা জরুরি। বিদেশ ফেরত যাত্রীরা ১৪ দিন সেলফ কোয়ারান্টাইনে থাকলে, পরে লক্ষণ দেখা দিলে যেন পরিবারের অন্যদের মাঝেও এ রোগ ছড়িয়ে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ টিম মাঠে নামাতে হবে।

বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রয়োজন করোনা আক্রান্তদের জন্য। সেটিতে নিখুঁত স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তারা যেন প্রবাসে থেকেই দূতাবাসের মাধ্যমে ওই দেশের সরকারের নিয়ম মেনে চলতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চীনে থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা নিরাপদে আছেন, তাহলে অন্যান্য দেশে থাকা বাংলাদেশিরা কেনো নিরাপদে থাকতে পারবেন না?

এমনকি ভাইরাসের উদ্ভব হুবেই প্রদেশের উহান শহরে থাকা বাংলাদেশিরাও আছেন ভালো এবং সুস্থ। দূতাবাস চাইলে আর সচেতন থাকলে সবই সম্ভব এটাই তার প্রমাণ। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে থাকা দূতাবাসগুলোকে তৎপর হতে হবে।

সরকারের মূল করণীয়র মাঝে জনসাধারণকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। করোনা নিয়ে গুজব সৃষ্টি করা যাবে না। অযৌক্তিক আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। স্বচ্ছ, সুন্দরভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে, অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধুলেই হবে। লাগবে না অতিরিক্ত কিছু। হাত ধুতে হবে বারবারে। হাত না ধুয়ে খাওয়া, চোখে-মুখে আঙুল ছোঁয়ানো যাবে না। হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি ও গণজমায়েত এবং সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চললেই হবে।

এছাড়া গণমাধ্যমকে পালন করতে হবে দায়িত্বশীল ভূমিকা। গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন) এ নিয়ে কিছু নিয়মনীতি অনুসরণ করার কথা বলেছে। যার মধ্যে রয়েছে, প্রতিবেদনে বেশি রঙ মিশিয়ে অনর্থক আতঙ্ক তৈরি না করা। প্রতিবেদন যেন সহজ-সরল হয়। লেখা, বলা কিংবা টেলিভিশনে দেখানোর সময় ভয় প্রদর্শন না করা। ছবি ব্যবহারে সতর্ক হওয়া। অতিরঞ্জিত, নাটকীয় শিরোনাম এড়িয়ে চলা ইত্যাদি। সরকার, সাধারণ জনগণের মতো সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে গণসচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গায় সজাগ থাকলে এই কোভিড নাইনটিন বাংলায় অন্তত উন্নত দেশগুলোর মতো মহামারি হবে না, এটা বলাই যায়।

 

সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর