করোনা এখন একটা আতঙ্কের নাম। হালকা সর্দি, হাঁচি, কাশি বা জ্বর হলেই ভয়- করোনা হলো কিনা। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে মহামারি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে যদিও এর প্রকোপ তেমন দৃশ্যত নয়, কিন্তু কোনোভাবেই করোনাকে এড়িয়ে চলতে পারি না। করোনা বাংলাদেশে ঢোকার আগে থেকেই সরকারিভাবে সতর্কতামূলক পরামর্শ থাকলেও যখন তিনজনকে শনাক্ত করতে পারলো তখনই সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তিগত যে যেভাবে পারছে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। সতর্কতাগুলোর অন্যতম হলো-গণপরিবহন ও জনসমাগম এড়িয়ে চলা, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি।
জীবনের তাগিদেই আমাদেরকে ঘর থেকে বের হতে হয়। জনবহুল এ নগরীর জনতার মাঝে আমাদের চলতে হয়। ঢাকায় আমাদের বেশিরভাগ লোকের এর বিকল্প নেই।
আমি সচরাচর মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারে অফিসে আসি। গতকাল খবরের পত্রিকায় দেখলাম- মোটরসাইকেল রাইড শেয়ার করতে হলে নিজ হেলমেট ব্যবহার করবেন। কথা সত্যি, কারণ রাইড-শেয়ারের হেলমেট যে হারে ব্যবহার হয় তাতে অবশ্যই করোনাভাইরাস লুকিয়ে থাকতে পারে। রাইড-শেয়ারের মাথার ঘাম অথবা ধুলো মিশ্রিত বাতাস আমাদের অনেকের সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও করোনাভাইরাস আতঙ্কে আমরা কাবু। তাই রাইড-শেয়ারে না এসে একটু সাবধানে বাসে উঠলাম। করোনার ভয়ে জানালার পাশে নড়াচড়া না করে পুতুলের মতো বসলাম। পাশের সিট কিছুক্ষণ খালি থাকার পর এক ভদ্র লোক এসে বসলো। আমি আরও নড়েচড়ে এমনভাবে বসলাম যাতে পাশের ভদ্রলোক হাঁচি বা সকালবেলার হাই তুললে আমি আহত না হই।
আমাদের স্বভাব। আপনি ঠিক থাকলে কি হবে অন্যজন আপনাকে নাড়াবেই। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ভদ্রলোক তার মুখের মাস্ক খুলে নাকে বাম হাতের আঙুল ঢুকিয়ে নাকের ময়লা বের করে আবার নাকে শুকে উনার সামনের সিটের কাভারে আঙুল পরিষ্কার করছে। হাঁচি দেওয়ার সময় মাস্ক খুলে মুখে হাত দিয়ে হাঁচি দিয়ে সে হাত আবার সামনের সিটের কাভারে ঘষে পরিষ্কার করছে। ভিড়ে অন্যরা তেমন খেয়াল না করলেও আমি বড়ই বেকায়দায়। সময় গুনছি কখন অফিসে পৌঁছবো। পাশের জানালার কাছে করোনার সচেতনতার পোস্টারও লাগানো আছে।
একটা প্রবাদ আছে- স্বভাব যায় না মলে, খাসলত যায় না ধুলে। আমাদের স্বভাব পরিবর্তন হবার নয়। আমরা সবাই জানি করোনার প্রভাব তেমন না হলেও করোনা আমাদের দেশে ঢুকেছে। প্রত্যেকে সতর্ক বা সচেতন না থাকলে আমাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, যার উদাহরণ আমরা চীন, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশগুলোতে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কতটুকু আমরা সচেতন হতে পেরেছি তাই দেখার বিষয়। নিজে সচেতন না হলে সরকার আমাকে বা আপনাকে সচেতনতা গিলিয়ে দিতে পারবে না। এমন বৈষয়িক মহামারিতে শুধু নিজে সুস্থ থাকার চিন্তাকেও সচেতনতা বলে না। নিজের পাশাপাশি অন্যরা যাতে সুস্থ থাকে তার ব্যবস্থাও করতে হবে। আমরা এই চিন্তার পুরো উল্টো বিধায় এক সন্ধ্যায় সব স্যানিটাইজার উধাও হয় আর রাতারাতি ত্রিশ টাকার মাস্ক হয়ে যায় দেড়শ থেকে দুইশ টাকা।
ঢাকায় স্যানিটাইজার ব্যবহার বা কেনার সামর্থ্য কতজনের আছে? যারা সাধারণ পণ্যের মতো বাজারের সব স্যানিটাইজার কিনে ফেলছেন, তারা কি ভাবছেন নিজেরা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিচ্ছন্ন থাকলেই করোনামুক্ত থাকা যাবে? আপনার আশে পাশে যারা থাকেন তারা যদি পরিচ্ছন্ন না থাকেন এককভাবে করোনাভাইরাস মুক্ত থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
চীনের পর ইতালিতেই করোনা আক্রান্ত মারাত্মক। সদ্য ইতালি থেকে আসা বাংলাদেশিদের করোনা আক্রান্ত সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখবে এটাই স্বাভাবিক। দেশের জন্য না হোক, অন্তত পরিবার পরিজনকে করোনামুক্ত রাখতে তাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকা উচিত। কিন্তু আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর ফেসবুক শেয়ার থেকে দেখতে পেলাম- আমাদের ইতালি থেকে আসা ভাইদের ব্যবহার। দেশ থেকে শুরু করে পুলিশভাইসহ সিস্টেমের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। হজ ক্যাম্পের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চাচ্ছেন না তারা। তারা বলছেন, বিমানবন্দরে তারা একবার টেস্ট করেছেন। আমাদের সিস্টেম যাই হোক সেভাবেই মেনে নিয়ে চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার না করে চৌদ্দ দিন থাকা উচিত কোয়ারেন্টাইনে। করোনা ঠেকাতে সবচেয়ে বড় ব্যবস্থা হচ্ছে কোয়ারেন্টাইনে থাকা। তাছাড়া করোনাভাইরাস চেহারা-চরিত্র ক্ষণে বদলে যায়।
ফেসবুকে আবার করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবও ছড়ানো হচ্ছে, যা আমাদের বিকৃত মন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ এবং অসৎ ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য।
পৃথিবীর সব কিছু বদলে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের খাসলত আগের মতোই রয়ে গেছে। আমাদের আর্থিক অবস্থান থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই উন্নতি হয়েছে, কিন্তু খাসলতে কোনো প্রকার উন্নতি হয়নি। কবে বদলাবে আমাদের খাসলত?
মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী