কয়েকদিন আগের একটা শিরোনাম ছিল এমন, ‘এস করোনাভাইরাস কেসেস রাইস, অল অব ইতালি ইজ ইন লকডাউন’ (As coronavirus cases rise, all of Italy is in lockdown), অর্থাৎ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, পুরো ইতালি এখন লকডাউন। ইতালি নামটা শুনলে যেন আঁতকে উঠি। এই ইতালিতে বর্তমানে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি, মারাও যাচ্ছেন রোজ এ দেশটিতে শত শত মানুষ। আমাদের বাংলাদেশে প্রতিবেশী চীন নয়, বরং করোনা এসেছে দূরের দেশ ইতালি থেকে। ইতালি ব্যবস্থা নিয়েছে, তবুও তারা হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। পুরো দেশে জারি আছে জরুরি অবস্থা। এতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বটে। কিন্তু যে করোনার বীজ ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে, তা কী করে সামাল দেবে তা নিয়েই দিনরাত বেগ পেতে হচ্ছে ইউরোপের উন্নত এ দেশটিকে।
করোনাভাইরাসের কারণে মানবতা এখন বিপন্ন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতো বড় সংকট বিশ্ব আগে কখনও মোকাবিলা করেনি। ব্রিটেন করোনা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। তাদের কর্মদক্ষতা ইতোমধ্যে প্রশংসা পেয়েছে। তবুও ব্রিটেনে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ এনে রাস্তায় হয়েছে বিক্ষোভ, হয়েছে প্রতিবাদ। তাহলে বুঝতেই পারছেন, মানুষ কতটা সচেতন! তারা আরও ভালো কিছু আশা করেন। উন্নত এ যুগে মানুষ মরবে, আর জীবিতরা বসে বসে দেখবে তা হতে পারে না।
এখন আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আমরা কী আশা করি? এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবো, তা নিয়ে কী ভাবছি? হঠাৎ হঠাৎ কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। কিন্তু কয়েক মাস মেয়াদী সিদ্ধান্ত নিতে পারছি কি? বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রীর বিভিন্ন কথা। প্রশ্ন হলো, দেশে কি করোনা নিয়ে রাজনীতি চলছে না? এই প্রশ্ন নতুন নয়। কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেই চোখের সামনে আসছে সব দলকে এক হয়ে কাজ করার কথা। এমন আহ্বান জানিয়েছেন খোদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরাই। তাহলে কেন হচ্ছে না এখনও এটা! পত্র-পত্রিকায় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা শুনলেই ‘রাজনীতি’ না ‘করোনা থেকে মুক্তির মানবনীতি’ চলছে তা স্পষ্ট হওয়ার কথা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য-আরএনএ বায়োটেক লিমিটেড করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে কিট উৎপাদন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন একটি দল গেলো ফেব্রুয়ারি থেকে কিট তৈরি ও উৎপাদনের কাজ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কিট তারা সরকারকে সরবরাহ করতে পারবে বলে জানিয়েছে। এরপর আগামী মাসে আরও লাখ খানেক কিট দেয়া যাবে। কিন্তু সরকার এদিকে নজর দিলো ঠিকই, কিন্তু একটু দেরিতে। যুক্তরাজ্য থেকে ১০ লাখ টাকার কাঁচামাল আসবে এবার, উৎপাদন হবে কিট। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল করেন বলেই কি এতোটা ভাবনা-চিন্তা ছিল সরকারের! আমরা আশা করবো, দেশে উৎপাদিত কিট যেন সরকার কাজে লাগায়। ২০০ টাকার মধ্যে এ কিট পাওয়া যাবে (এই টাকায় সরকারের কাছে বিক্রি করবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র)। বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করার সময় এখনই।
এবার আসি একটা ব্যক্তিগত বিষয়ে। ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে সরকারি নির্দেশনা মেনে বাড়িতে সঙ্গরোধে থাকেননি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার করাব গ্রামের বাসিন্দা মাসুক মিয়া। উল্টো ধুমধাম করে বিয়ে করেছেন সম্প্রতি। বিষয়টি জানতে পেরে তার বৌভাত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। স্ত্রীসহ মাসুক মিয়াকে বাধ্যতামূলক বাড়িতে সঙ্গরোধে পাঠানো হয়। জানা যায়, গেলো ১১ই মার্চ ফ্রান্স থেকে দেশে ফেরেন মাসুক। বিদেশ থেকে ফিরে যেখানে তার দুই সপ্তাহ (২৬শে মার্চ) পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সঙ্গরোধে থাকার কথা, সেখানে তিনি সেটা করেননি। তিনি একটি উদাহরণ মাত্র। এখন প্রতিদিনই টেলিভিশনের টিকার ও পত্রিকার পাতায় আমরা দেখছি, সঙ্গরোধের নির্দেশনা না মেনে জরিমানা করার তথ্য-সংবাদ। বিদেশ থেকে এসেছেন ভালো কথা, করোনা শরীরে থাকলে- পুরো পরিবার, সমাজ তথা দেশকে আক্রান্ত করতে চান আপনারা? কী আশ্চর্য মানুষ বটে! আসলে কী আশ্চর্য বাঙালি বলা চলে! যেখানে সচেতন হয়ে উল্টো আপনাদের দেশে না আসা উচিত ছিল, সেখানে জোর করে চলে এলেন, এখন বাহাদুরি করে দেশকে ফেলছেন ঝুঁকিতে! কাণ্ডজ্ঞান কবে হবে আপনাদের!
বাড়িতে সঙ্গরোধের বিষয়ে কথা বলা জরুরি। সারাদেশে ৬ হাজারের (তারা বিদেশ ফেরত) বেশি মানুষ সঙ্গরোধে রয়েছেন নিজ বাসায়। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশের করোনাভাইরাস থাকলে সেটা পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এভাবে করে ধীরে ধীরে আরও বিস্তার হবে। বাড়িতে সঙ্গরোধে থাকা প্রবাসীরা নিয়ম মানছেন, এটা কীভাবে আপনি নিশ্চিত হবেন বলুন! যেখানে বহু মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে জরিমানা গুনছেন, জেলেও পাঠানোর সংবাদ দেখেছি, কেউ কেউ বিয়েও করছেন, এমন দেশে সঙ্গরোধের নিয়ম মানা নিয়ে দ্বিধা, সংশয় থাকবে এটা স্বাভাবিক নয় কি? তাই বাড়িতে সঙ্গরোধ মানে লোক দেখানো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে বিশ্বাস করেন অনেক সচেতন মানুষ। এখানে পরিবারের সঙ্গে অবশ্যই মেলামেশা হয়। ধরলাম বেশিরভাগ করেন না। কিন্তু যারা করছেন তারা কি করোনা ছড়াচ্ছেন না পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে? এটা তদারকি করছে কে! সরকার কীভাবে নিশ্চিত ঘরে থাকলেই সংক্রমণ ছড়াবেন না তিনি? যে লোকগুলোর সামান্য বোধ শক্তি নেই, তাদের বাসায় রেখে করোনা প্রতিরোধ করে ফেলেছেন বলে বাণী দিচ্ছেন! এভাবে করোনা ছড়াবেই। আটকানোর কোনো উপায় নেই, টের পাবেন দুই সপ্তাহ পর। নতুন ব্যবস্থা নিন দ্রুত।
প্রথম দফায় জানুয়ারির শেষে যখন চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে কিছু শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে আনা হলো, রাখা হলো রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা হজ ক্যাম্পে। সেটাই ছিল মূল পর্যবেক্ষণ। প্রায় দুই সপ্তাহ তারা ছিলেন সেখানে। কিন্তু এখন বাড়িতে সঙ্গরোধের নামে যা হচ্ছে তা স্রেফ লোক দেখানো। আগের মতো পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনুন দ্রুত।
ধরে নিলাম বাড়িতে সঙ্গরোধে বা যেকোনোভাবে ১৭ই মার্চ যিনি আক্রন্ত হলেন সাধারণ হিসেবে তিনি পহেলা-দোসরা এপ্রিলে গিয়ে বুঝবেন জ্বর, কাশি, হাঁচি, সর্দিতে ভোগার বিষয়টি। এরপর তিনি চিকিৎসা নেবেন। এর আগে যিনি পহেলা মার্চ আক্রান্ত হয়েছেন... যিনি দোসরা মার্চ আক্রান্ত হয়েছেন, যিনি তেসরা, চৌঠা মার্চ, ৫ই মার্চ যিনি আক্রান্ত হয়েছেন... তাদের সংখ্যা কত? তাদের আক্রান্তের খবর একে একে আসবে না এখন? তাহলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে না? পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ আমরা সেভাবে অনুধাবন করার কথা করছি না। ইতোমধ্যে করোনায় মারা গেছেন, এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা আন্দাজ করতেও পারছি না আমরা।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিতে অনেকে কক্সবাজার ভ্রমণে গেছেন এমন খবরও শোনা যাচ্ছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় হয়েছে, তারপরে কিছু কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আপনি কি মনে করেন না, পর্যটন কেন্দ্র বাদেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ভ্রমণের সুযোগ এখনও রয়েছে? যেখানে জনসমাগম এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আমরা এই হঠকারিতা করি কী করে! অনেকে গ্রামের বাড়ি গেছেন। সেখানে আড্ডা, ঘোরা ফেরা নিষিদ্ধ করা জরুরি। থাকতে হবে বাসায়। বাংলার গ্রামে গ্রামে এই ভাইরাস ছড়িয়ে গেলে মৃত্যুপুরী হয়ে পড়বে এদেশ! তাই অনুগ্রহ করে সবাই একটু সাবধান হবেন, বাস্তবতা বুঝতে হবে সবাইকে। এছাড়া দেশের সব পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে, ছোটখাটো শিল্প প্রতিষ্ঠানও চালু রাখার জো নেই। মসজিদসহ অন্য উপাসনালয় নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জাত, ধর্ম গেলো বলে, আগের ভাবধারা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
ইতালিতে সব বন্ধ। ফ্রান্সেও তাই। ছুটি পেয়ে দেশে এসে প্রবাসীরা ছড়িয়ে দিলেন করোনাভাইরাস। সরকারও তাদের আলাদা করে সঙ্গরোধে না রেখে পাঠিয়ে দিলো বাসায়। অনেক ক্ষেত্রে নির্ণয়ই করা গেলো না করোনা আছে কিনা। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হলো। আমরা ফ্লাইট বন্ধ করলাম ইউরোপের সঙ্গে ঠিকই কিন্তু অনেক পরে। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আবার ফ্লাইট বন্ধের পর অনেক প্রবাসী চালাকি করেও ঢুকেছেন দেশে। পরিচয়ও তারা দিতে চান না যে, সদ্য বিদেশ ফেরত। এটা মূল্যবোধের অবক্ষয় নয় কি! অনেকেই বলছেন, টানা দুই মাস সময় পেয়েও আমরা বিস্তার রোধ করতে পারলাম না! কী দুর্ভাগ্য আমাদের! আমি বলি, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, এখন কি অন্তত এক হতে পারবো না আমরা? একমত হয়ে কাজ করা কি সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে? দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করে দেখাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে কারফিউ। ইতালি, ফ্রান্সসহ বহু দেশে রেড জোন। সৌদি আরবে আক্রান্ত খুব বেশি নয়, তাও তারা সব মসজিদ বন্ধ করেছে (দুটি বাদে সব)। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাসায় নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমরা কেবল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা বাদে আর কি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছি বৃহস্পতিবার (১৯শে মার্চ, ২০২০) পর্যন্ত?
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই লকডাউন বলবৎ থাকবে (এ জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী বেশি, প্রবাসী বেশি)। এখন কি শুধু একটা জেলা, উপজেলা নিয়ে ভাবার সময়? ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পুরো দেশ লকডাউনের সময় আসেনি? সরকার অবশ্য বলেছে, প্রয়োজনে করা হবে লকডাউন। কিন্তু কবে? ভাইরাস জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়লে! এই সংকটের মধ্যেই কি আমরা কাজ করে উন্নত অর্থনীতির দেশ হয়ে যাবো! আপাতত সব বন্ধ করে দিলে ক্ষতি কি! শুধু বন্ধ করার দাবিই নয়, জেলায় জেলায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপন জরুরি। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হলেও স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কয়েকদিনের জন্য এটা করা কি খুব কঠিন কাজ? ডিজিটাল বাংলাদেশে অনেক কিছুই এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলে, তাহলে সংকোচ কিসের? এদেশের নাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, অর্থাৎ জনগণের সরকার। প্রজাতন্ত্র হলো এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ, সেই জনগণের স্বার্থেই এখন বলার সময় এসেছে, প্লিজ লকডাউন দ্য কান্ট্রি। পুরো দেশকেই বাঁচাতে হবে। কোভিড-১৯ এ দেশে মহামারি হোক তা আমরা চাই না কেউ।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক।