একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে দেশ ও বিদেশের পুঁজি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় ন্যাশনাল ও মাল্টিন্যাশানাল করপোরেট হাউস, যারা অবাধ ও লাগামহীন মুনাফা অর্জন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নীতিতে মুনাফার মনোবৃত্তিই প্রধান। কিন্তু যে কর্মীদের নিয়ে তারা জনগণ ও ভোক্তাদের কাছ থেকে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে, তাদের প্রতি এবং যে সমাজ থেকে লাভ করছে, সেই সমাজের প্রতি করপোরেটগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য অস্বীকার করতে পারে না।
এই মানবিক-সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে করপোরেট দুনিয়ায় সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি নামক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে ও করপোরেট কালচারে সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি একটি আবশ্যিক কর্তব্য রূপে পরিগণিত হচ্ছে, যার প্রমাণ বিশ্বের উন্নত দেশে বিভিন্ন আর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, বিনোদনের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ভাবে দেখা যাচ্ছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বিশ্বের বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো হাসপাতাল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও শিক্ষা গবেষণা ইত্যাদি নানাবিধ কাজে জড়িত হয়। এগুলো তারা এমনি এমনি করে না। প্রতিষ্ঠানের সুনাম বাড়াতে ও দায়িত্ব হিসেবেই করে এবং নানা মানব ও সমাজকল্যাণমূলক ফিলনথপি বা দান করায় প্রতিষ্ঠানগুলো কর রেয়াত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ভুর্তকি পায়।
বিশ্বের নানা দেশের কল্যাণ কাজে ফোর্ড, বিল গেটস, টাটা, বিড়লা ইত্যাদি বিসনেস টাইকুনের বিশাল বিশাল সামাজিক ও মানবিক কল্যাণ প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত রয়েছে। জাতীয় দুর্যোগ ও বিপদের সময়ে এ দায়িত্ব করপোরেটগুলো আরও বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারি জনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় করপোরেট ও বিভিন্ন কোম্পানি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে।
বিয়ার উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী জার্মান কোম্পানিগুলো নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে ন্যাপকিন, মাস্ক, স্যানিটাইজার বানিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করছে। বিশ্বসেরা ফরাসি সেন্ট, ওডিকোলন ও বিভিন্ন সুগন্ধি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের স্বাভাবিক উৎপাদন স্থগিত করে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য জরুরি বিভিন্ন সামগ্রী ও উপাদান বানিয়ে মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে শুরু করেছে।
ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো করোনাভাইরাসের সংকুল পরিস্থিতিতে দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখছে। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে সংকট মোকাবিলায় আর্থিক ও বস্তুগত সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি কোম্পানিগুলো সামনে দিনে করোনা স্টেজ ৩ বা ৪ পর্যায়ে চলে গেলে কী কী করতে হবে, সে প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে। তারা ব্রিটেনের সর্বত্র আইসোলেশন ক্যাম্প, ভেন্টিলেশান, বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণে লেগে গেছে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে জাতির লড়াইয়ে তারা লড়ছে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে।
উপরোক্ত উদাহরণের বাইরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্ক্যান্ডানেভিয়ান দেশসমূহে করপোরেট বিসনেস হাউসগুলো আর্থিক ও জনশক্তি নিয়ে সরকারের সহযোগী হিসেবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিপদের প্রকোপ কমাতে ও প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে তারা কাজ তো করছেই, এমনকি এই ভাইরাসের ওষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঢেলে দিচ্ছে।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধে করপোরেট কোম্পানিগুলোর মহত্তম অবদানের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সত্যিই হতাশাজনক। এদেশে সেবা, খাদ্য, ওষুধ, ব্যাংকি, বিমান পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে শত শত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। কিন্তু যে মানুষ ও সমাজের কাছ থেকে তারা মুনাফা হাতিয়ে নেয়, তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনও নমুনা তারা দেখাতে পারছে না।
এজন্য তাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতা অনেকাংশে দায়ী। কর্মী ও ভোক্তাদের জন্য ভালো কিছু করে ব্যবসার ভবিষ্যৎ রক্ষা করার দূরদর্শিতা তাদের নেই। তারা আছে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক লাভের মতলবে।
তদুপরি প্রকৃত করপোরেট স্ট্রাকচার বলতে যা বোঝায়, সেই কাঠামো তারা নির্মাণ করতে পারছে না। করপোরেট কালচারের অনুসরণও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো পাবলিক শেয়ার ও সরকারের অংশীদারত্বের মাধ্যমে লোন বা ভর্তুকির সকল সুবিধা নিলেও মালিকানাকে করে রেখেছে ব্যক্তি বা পরিবারের পকেট-বন্দি। নামে করপোরেট হলেও তারা প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিগত-পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এবং এদের দৃষ্টি আর নীতি-আদর্শও সীমাবদ্ধ। ফলে এদের কাছ থেকে করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি পাওয়া যাচ্ছে না।
সংকটকালে মানুষ ও কর্মীদের প্রতি এদের দায়িত্ব না নেওয়াটা ভীষণ অন্যায়ই শুধু নয়, অপরাধও বটে। যে মানুষ তাদের পণ্য কিনে বা সেবা নিয়ে মুনাফা দিচ্ছে এবং যে কর্মীগণ প্রতিষ্ঠানকে সচল রেখেছেন, তাদের স্বার্থ না দেখলে তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবেন। এসব প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে শুধু লাভ হাতানোর মানসিকতার বিষয়ে সরকারকেও কঠোর হতে হবে।
কারণ, সংকট ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা ও শক্তি বাড়াতে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ লাগবে। শুধু সরকার বা জনগণ নয়, করপোরেট আর্থিক সেক্টরেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এক্ষেত্রে। করোনাভাইরাসের যে বিপদ বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে, তার ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এই বিপদ কতদিন স্থায়ী হবে, তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও বিকল্প নেই। এবং তা শুধু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক ক্ষেত্রেই নয়, মানুষ ও সমাজের নানা মৌলিক চাহিদার যোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হতে হবে। করোনার জনবিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির প্রয়োজনে কোম্পানিগুলোকে ন্যায্য মূল্যে বাড়িতে বাড়িতে নিজস্ব পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে। কর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে। আপতকালীন সময়ে মুনাফার চিন্তা বাদ দিতে হবে এবং সাধ্য মতো আর্থিক, বস্তুগত ও লজিস্টিক সহযোগিতা করে সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি দেখাতে হবে। জাতির চরম সংকটকালে তারা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারে না। সকলের মতো তাদেরকেও বিপদ উত্তরণে অবদান রাখতে হবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।