সবাই যখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত, সবার চোখ যখন একদিকে নিবদ্ধ সেই এক চোখের হরিণের মতো, তখন পাহাড়ে পাহাড়ে শিশু মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ বড় হচ্ছে। অন্য সময় হলে এতদিনে দুই একটা সংবাদ সম্মেলন করে বলে দেয়া হতো গুজবে কান দেবেন না। দুই একটা বিছিন্ন ঘটনায় কাতর হবেন না। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে কারো কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণিত হলে সে যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
বছর তিনেক আগে ২০১৭ সালে এমনটিই হয়েছিলো। সেদিন যিনি ডিজি হেলথ ছিলেন আজো তিনিই আছেন। তার অবসরের সময় হলেও যেতে দেয়া হয়নি। করিতকর্মা লোকের অভাব পূরণ করছেন তিনি। সেদিন তিনি কথা দিয়েছিলেন আমরা সীতাকুণ্ডের পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। সেবার সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে হামে আক্রান্ত হয়ে নয়জন শিশু মারা যায়।
তখন এসডিজি (সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল)’র এতো তেল চুকচুক অবস্থা হয় নি। তারপরেও বলা হয়েছিলো ‘কেউ বাদ থাকবে না’ (নো ওয়ান উইল লেফট বিহাইনড) এসডিজি’র মূল কথা। এমন কথায় বিমোহিত হয়েছিলেন উপস্থিত সবাই। বলা বাহুল্য, এসবই ছিল কথার কথা, ছেলে ভুলানো, চিড়া ভেজানো কথা। সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচির ফাঁক-ফোকরগুলো বন্ধ করা হয়নি। প্রতিশ্রুত “ওয়ার্ডভিত্তিক ‘মাইক্রোপ্লান’ কে মূল্যায়ন করে পুনর্বিন্যস্ত ও বেগবান করা হয়নি। ফলে হামের আক্রমণ বন্ধ হয়নি, ঠেকানো যায়নি শিশুর মৃত্যু।
মিরসরাই সদর ইউনিয়নের মধ্যম তালবাড়িয়া গ্রামের ২০১৮ সালে হামের ছোবলে শিশুমৃত্যুর খবর আসে রাজধানীতে। পরের বছর (২০১৯) খবর হয় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির। ফটিকছড়ির বাগান বাজার ইউনিয়নের পাতাছড়া গ্রামের ত্রিপুরা পল্লীর শিশুরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয় হামে। এসব ঘটনায় মনে হতে পারে এগুলো দেশের কোনা কাঞ্চির হটাৎ খবর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নানা মূল্যায়ন প্রতিবেদনের প্রতিফলনগুলো আমলে নিলে দেখা যায় দেশের প্রায় ২০ লাখ শিশু হামের ঝুঁকিতে আছে। এরমধ্যে ঢাকার বস্তিও আছে। শতকরা ১০টি শিশু সময়মতো এক বা একাধিক টিকা পায়নি; কেউ আবার একেবারেই পায় না। দেশের মোট ৪৩ জেলায় সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচির কোনো না কোনো ঘাটতি আছে। নয়টি জেলার পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপ হয়েছে। টিকা প্রদানে আমরা তৃতীয় বিশ্বে রোল মডেল হয়ে একদিকে যেমন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি অন্যদিকে নানা অবহেলায় আমাদের অর্জনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
গত ১৬ মার্চ ঢাকার সংবাদপত্রগুলোতে লামার হামের খবর ছাপা হয়। এর সপ্তাহখানেক আগে এক কাঠ ব্যবসায়ী বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত লামার সদর ইউনিয়নের পোপা মৌজায় পুরাতন লাইল্যা পাড়ায় গিয়ে দেখতে পান পাড়ার প্রায় প্রত্যেক ঘরে শিশুরা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ব্যবসায়ী পাড়ায় থাকতেই একজন শিশু মারা যান। সদর ইউনিয়নে তাউ পাড়ার উপরে ডলুঝিরি মুখ দিয়ে একটু আগালেই সামনে পড়ে পাড়াটা। উপজেলা সদর থেকে বড় জোর ২০ কিলোমিটার দূরে হবে এই পাড়াটা। যেতে সময় লাগলেও একেবারে অচেনা অজানা পাড়া এটা নয়। এই পাড়া থেকে প্রতি সপ্তাহে লামা বাজারে বাজার করতে আসেন পাহাড়িরা। কাজেই কথিত পাড়াবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা দুরূহ এই যুক্তি টেকানো কঠিন।
কাঠ ব্যাবসায়ীর বরাত দিয়ে নানা অনলাইন আর ঢাকার সংবাদ মাধ্যমে হামে মৃত্যুর খবর চাউর হয়ে গেলে সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেন। প্রথমে একজন উপ-সহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ একটি মেডিকেল টিম উপদ্রুত পাড়ায় গিয়ে কিছু ওষুধপথ্য দিয়ে ফিরে যান। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে লামা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন কয়েকজনকে নিয়ে আবার পুরোনো লাইল্যাপাড়ায় যান। তারপর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় নারী, শিশুসহ ৩৭ জনকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয়। আক্রান্তদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন।
এ খবর বাসি হতে না হতেই মারাত্মক অবহেলার খবর আসে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থেকে। লামার পুরাতন লাইল্যা পাড়ার চাইতেও বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে বাঘাইছড়ির শিয়ালদাইলুই মৌজা। গত মাসের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাজেক ইউনিয়নের অরুন পাড়া গ্রামে শিশুদের প্রথমে জ্বর পরে তাদের সারা শরীরে ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা দেয়, সেই সঙ্গে থাকে কাশি। একে একে ওই গ্রামের প্রায় ৩০ জন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১০ দিনের মাথায় ২৬ ফেব্রুয়ারি অরুন পাড়ার সুজন ত্রিপুরার মেয়ে সাগরিকা ত্রিপুরার (১১) মারা যায়। যেহেতু কাগজে কলমে হামের টিকা দেয়ার কথা, তাই প্রথমে এ রোগটি অজ্ঞাত রোগ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
সাজেক ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সীমান্তবর্তী তিনটি গ্রাম অরুন পাড়া, লুংথিয়ান পাড়া এবং হাচ্চে পাড়ায় গত কয়েকদিনে হামে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মারা যায় মোট ছয় শিশু। স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, এখনো কমপক্ষে আরো ১০৭ শিশু মৃত্যুর প্রহর গুণছে। এরা সবাই বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের শিয়ালদাইলুই মৌজার তিনটি পাড়ার বাসিন্দা। এলাকাটি রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও খাগড়াছড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। নৌপথেও শিয়ালদাইলুই মৌজা থেকে সহজে খাগড়াছড়ি আসা যায়। সেই অর্থে দুর্গমতার অজুহাত এখানে ঠেকানো কঠিন। প্রশাসনিক জটিলতার বাক্স থেকে বেড়িয়ে এলেই কাজটা সহজ হয়ে যেত।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরে সীমান্তবর্তী শিয়ালদাইলুই এলাকার তিনটি গ্রামের শিশুদের হামের খবর পাচ্ছিলাম। বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই তারা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সেখানে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা সেবা পৌঁছানো কঠিন হচ্ছে। একটি মেডিকেল টিম সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। প্রয়োজন হলে আক্রান্ত শিশুদের হেলিকপ্টারে করে খাগড়াছড়ি অথবা দিঘিনালায় নিয়ে চিকিৎসার দেয়া হবে।
অবশ্য রাঙামাটির সিভিল সার্জনের মতে, হাম থেকে নিউমোনিয়া হয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে। তিনি আশাবাদী, ওই এলাকায় বিজিবির সহযোগিতায় হেলিকপ্টারে করে আরেকটি বিশেষ মেডিকেল টিম গেলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
এসব বয়ানে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার তৎপরতার খোঁজ খবর মেলে, কিন্তু কেন এখনো হাম হচ্ছে আর কোন গাফলতিতে শিশু মারা যাচ্ছে, তার নিকেশ মেলে না। মনে হচ্ছে, আমরা ত্রিশ বছর আগের বাংলাদেশে বসে আছি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের আরেকটু সৃজনশীলতারে সঙ্গে তৎপর হতে হবে। রোল মডেলের মেডেল স্যাকরার নিক্তিতে হালকা হলেও বাস্তবে এর ওজন অনেক বেশি, তার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহিতার ঝক্কি।
গওহার নঈম ওয়ারা, গবেষক