আতঙ্ক ও বিষাদের করোনাভাইরাস-জনিত পরিস্থিতিতে দেশে-বিদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। দলীয় দ্বন্দ্ব, সংঘাত আর যুদ্ধাবস্থারও আপাতত অবসান হয়েছে।
বাংলাদেশে কারাবন্দী বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আশা জেগেছে। মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) আইনমন্ত্রী জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুইটি শর্তে ছয়মাসের জন্য তার সাজা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শর্ত দুটি হলো এ সময়ে তার ঢাকায় নিজের বাসায় থাকতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের নানা দেশে রাজনৈতিক দূরত্ব ও বিভেদ অনেকাংশে কমে এসেছে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতিতে। ভারতের গোলযোগপূর্ণ রাজ্য কাশ্মীরে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে নেতৃবৃন্দকে। ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো স্থিতাবস্থায় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগ থেমে আছে। ব্রিটেন ও ইউরোপে ব্রেক্সিট নিয়ে তুমুল আলোচনা ও মতবিরোধের বিষয়গুলোও আপাতত শীতল।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিশ্বের নানা স্থানে চলমান যুদ্ধগুলো অঘোষিত বিরতি মেনে নিয়েছে। সিরিয়া, ইরাক পরিস্থিতি শান্ত। দৃশ্যও শান্ত আছে অস্থির ও সংঘাতময় আফগানিস্তান।
২০২০ সালের শুরুতে ইরানি জেনারেল সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরে যে প্রবল উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিল, সেটাও স্তিমিত। খোদ ইরান ভয়াবহ করোনায় আক্রান্ত। প্রতিপক্ষ সৌদি আরব ওমরাহ বন্ধ করে দরজা-জানালা লাগিয়ে দিয়েছে করোনা ঠেকাতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন পশ্চিমা শক্তিও মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের যাবতীয় তৎপরতা বন্ধ করে নিজ নিজ দেশের দিকে মনোযোগী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই চরমভাবে করোনায় ভীতিকর বিস্তারের মধ্যে রয়েছে।
উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীন প্রবলভাবে করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত। এই সঙ্কট কাটাতেই নিজের সকল শক্তি নিয়োজিত করেছে চীন।
চীনের পর পরই ইউরোপের দরজায় হামলা করে করোনা। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইতালি ও স্পেন। জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন আছে বিপদের মুখে।
ফলে অনেক বিপদের মধ্যে বিশ্ববাসীকে নিপতিত করলেও করোনা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সুবাতাস এনেছে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন-শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যেও বোধোদয়ের সঞ্চার হয়েছে। আন্তঃকলহ ও লড়াই ছেড়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দের অনেকেই করোনাভাইরাসের আগ্রাসী পরিস্থিতিকে 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে'র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে যুদ্ধ দেশে নয়, চলছে মানুষ বনাম রোগের মধ্যে।
বিশ্বের সবাই এখন একবাক্যে এই সত্য স্বীকার করছেন যে, পৃথিবী, সভ্যতা ও মানুষের বিপদ এখন সবচেয়ে বেশি। বিপদ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণ রোগ, ব্যাধি, জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণেই বাড়ছে, যা মোকাবেলার অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো শান্তি ও পারস্পরিক ঐক্য। বিশেষত, বৈশ্বিক মহামারীর বিপদ ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করে কিছুই করা সম্ভব নয়। লড়তে হবে সবাইকে মিলে এবং পারস্পরিক ঐক্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।
এই শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ায় করোনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। সম্মিলিত ফান্ড গঠন করা হচ্ছে। আন্তরাষ্ট্রীয়ভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করা হচ্ছে করোনা ঠেকাতে।
সন্দেহ নেই, পৃথিবীর এই সুপ্রাচীন সভ্যতা বিকশিত হয়েছে সম্ভাবনা ও আশঙ্কার মধ্য দিয়েই। সুসময়ের নানা শিক্ষা যেমন পৃথিবী পেয়েছে, তেমনি দুঃসময়ের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগিয়েছে। এভাবেই বিশ্ব ও মানব জাতি এগিয়ে এসেছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের গ্লোবাল ভিলেজে।
মোদ্দা কথা, এই অতি-অগ্রসর ও অতি-বিকশিত পরিস্থিতিতেও করোনাভাইরাসের আঘাতের ফলে পৃথিবীর নানা দেশ অর্জন করছে চরম ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা, যে শিক্ষায় রাজনৈতিক ও সামরিক হানাহানি হ্রাস পেয়ে বিশ্বশান্তি ও মানবিক নিরাপত্তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই বোধ ও বিবেচনা স্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী হলেই ভালো। কঠিন শিক্ষা থেকে ভালো কিছু অর্জিত হয়ে যদি বিশ্বশান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে তা সকল বিশ্ববাসীর জন্যেই মঙ্গলময় হবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।