চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভাইরাস গোটা পৃথিবীকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। এই পৃথিবীর মানুষের স্মৃতিতে একত্রে এর থেকে বড় কোনও বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা নেই। এই বিপর্যয়ে তারা শিক্ষা পাচ্ছে পৃথিবী নিয়ে ভাববার। জলবায়ু নিয়ে ভাববার। সরকার শিক্ষা পাচ্ছে তথ্য গোপন না করার। যে চীনা ডাক্তার এই ভাইরাস নিয়ে প্রথম মুখ খুলেছিলেন, তার কণ্ঠ যদি স্তব্ধ করে না দেওয়া হত- বিপর্যয় আজ আমাদের এভাবে দেখতে হত না। জাত-ধর্ম সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানব ধর্ম রয়েছে- সেটি নিয়ে ভাববার কথাও বলছে করোনাভাইরাস- কোভিড-১৯।
সবচেয়ে বড় একটি শিক্ষা আমরা আমাদের বাড়িতে পাচ্ছি। সোশ্যাল গেদারিং-এর নামে, পেশাগত প্রতিযোগিতার নামে আমরা আমাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে পরিবার আসলে কী গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির উঠোনে, বারান্দায় গল্প-আড্ডায় গান শোনা, বই পড়া, রান্না করা, হাসাহাসি - এগুলোই জীবনের আসল আনন্দ। কারণ জীবন অনেক ছোট।
করোনা ঘনবসতিতে বেশি ছড়ায়। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। সরকার ডিসেম্বর থেকে প্রস্তুতি না নিয়ে বসেছিল কার অপেক্ষায় বোঝা গেল না। অথচ আমেরিকার মত উন্নত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি যুদ্ধাবস্থার মত করে করোনার মোকাবিলা করছেন। তিনি নিজেকে যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছেন। ৬০০ মিলিয়ন হসপিটাল মাস্ক দিচ্ছেন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য। এগিয়ে আসছে তাদের দেশের অ্যাপেলসহ বড় বড় কোম্পানিগুলো। কর্মচারী যারা ঘরে বসে থাকবেন, তাদেরও মাস শেষে বেতন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তারা। তারা বড় দেশ, প্রতিটি রাজ্যে করোনা ছড়িয়েছে।
আমাদের দেশ ছোট, কিন্তু প্রতিকারের উদ্যোগ কেন ছোট হবে? সরকার যদি দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দৃশ্যমান প্রস্তুতি না নেয়, তবে জনসাধারণ তো মনোবল হারাবেই। সবশেষে ২৪ মার্চ থেকে সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে করোনা মোকাবিলার সশস্ত্র বাহিনী দায়িত্ব পালন শুরু করায় অনেকের মধ্যে স্বস্তি এসেছে। সেনাবাহিনী নামানোয় জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছে সত্য, কিন্তু ভাইরাস যদি কমিউনিটি পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এই স্বস্তিও হারিয়ে যাবে। ইতালি সরকার সামান্য অমনোযোগী হওয়ায় তাদের সর্বনাশ হয়েছে। চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে তাদের মৃতের সংখ্যা। অথচ মাসখানেক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। মৃতের সংখ্যা ছিল এক। এখন এক দিনেই করোনায় মৃতের সংখ্যা ৬-৭শ’ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের দায়িত্বহীনতায় ইতালির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে করুণ পরিণতি আসতে পারে আমাদের ভাগ্যে। বাংলাদেশের এই স্বাস্থ্য অবকাঠামো নিয়ে তখন পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব হবে না। আমাদের গাফিলতিতে সৃষ্টি হবে মনুষ্যসৃষ্ট ‘গজব’।
কোনো রোগের জটিল অবস্থায় আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে এটাই বড় ধরনের সংকট এবং সেবার মূল্য সিংহভাগ মানুষের নাগালের বাইরে। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকতে পারে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, টাকার অভাব হবে না। টাকার অভাব না হলে সবকিছু মজুদ করে প্রস্তুত থাকতে গড়িমসি কেন?
বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। তবে বর্তমানে ইউরোপ এর কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। আগেই বলেছি, ইতালির অবস্থা চীনের থেকেও ভয়াবহ। জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, জার্মানির ৭০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হবে। তিনি কোয়ারেন্টাইনে গেছেন, ব্যক্তিগত ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে চীনের পরেই ইরান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানের ভাইস-প্রেসিডেন্টসহ ডজনখানেক সংসদ সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইনে গেছেন। কারণ তার স্ত্রীর দেহে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও করোনা আক্রমণ করেছে বলে গুজব ছড়িয়েছিল, কিন্তু পরীক্ষা করে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত নন। তবে করোনাভাইরাস হোয়াইট হাউসের পথ চিনেছে। ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারত। তার জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। বিশেষজ্ঞরা হিসাব-নিকাশ করে বলেছেন, ভারতে ৩০ কোটি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে। তাই যদি হয়, তবে এই উপমহাদেশকে গ্রাস করতে পারে করোনা। বাংলাদেশ চিকিৎসার আয়োজন খুব দ্রুতগতিতে বাড়ানোর উদ্যোগ এখনই না নিলে মহা বিপদে পড়তে পারে। ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী ৩১ মার্চ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপদজনক সময়। এই সময়ে সরকারের উচিত তার প্রস্তুতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য এবং কার্যক্রম দেখে মানুষের ভীতি কমবে, মানুষ গুজব থেকে তাদের কান সরাবে, সবাই মোকাবিলায় একযোগে কাজ করবে।
সরকারের তথ্য প্রবাহের অপ্রতুলতায় এমন কথাও রটেছে যে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি, কিন্তু সরকার তা গোপন করছে। কোনও সুস্থ মস্তিস্কের লোক যদিও তা বিশ্বাস করতে পারে না। রোগীর সংখ্যা গোপনের মধ্যে সরকারের কি লাভ আছে! করোনাতো সরকার সৃষ্টি করেনি। আর এটা সাধারণ মৃত্যু নয়। যদি ঠিকমতো লাশ দাফন করা না হয়, এই লাশই করোনা বোমা হয়ে একটি জনপদকে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। এটা বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে।
অরক্ষিত বিমানবন্দর আর বিদেশ থেকে আসা লোকের কারণে করোনা ছড়াচ্ছে বেশি। সুতরাং বিদেশ থেকে আসা লোকদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় না আনলে করোনা দ্রুত সারা দেশকে গ্রাস করবে।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে চালের দাম বাড়ছে দ্রুতগতিতে। বেকার হয়ে গেছে লাখ লাখ লোক। যারা বস্তিতে থাকে, তাদের প্রতি সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। আর প্রয়োজনে যেন বস্তিতে রিলিফ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। করোনা প্রতিরোধে কোনও দেশ প্রস্তুত ছিল না। আচমকা এই রোগের আত্মপ্রকাশ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। কিন্তু রোগটা ছড়াচ্ছে খুবই দ্রুত গতিতে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার পর্যন্ত এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে হয়তো, কিন্তু শেষ করা যাবে না। সুতরাং সরকারকে সব কিছুর খুব দ্রুত প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্যে করোনা পরীক্ষার জন্য কিট উদ্ভাবন করেছেন বলে মিডিয়ায় এসেছে। পলিমার চেইন রিয়েকশন সংক্ষেপে পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা সনাক্ত করতে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা লাগে। আর গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিট দিয়ে পরীক্ষা করতে ৩৫০ টাকা লাগবে মাত্র। দেখলাম তিনি ২০ কোটি টাকা সাহায্য চেয়েছেন। সরকারে উচিত এটিকে যাচাই বাচাই করে, বিনিয়োগ করে, কাজে লাগানো। গণস্বাস্থ্যের জাতির প্রতি এই দায়িত্ববোধ বহুকাল মানুষ স্মরণে রাখবে আর জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও গবেষক ডা. বিজন কুমার শীলের টিমের অবদানও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের উভয়কে জাতির পক্ষ থেকে অশেষ ধন্যবাদ।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঘটনায় আমরা আরেকটা শিক্ষা নিতে পারি। কোভিড-১৯ হচ্ছে মারাত্মক জীবন বা মৃত্যুর সংগ্রাম। এটি আমাদের দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ- যার জন্য আমাদের সব নাগরিকের দায়িত্ব নেওয়া দরকার। এটির দ্রুত সমাধানও হবে না – এর জন্য সময়, উদ্ভাবন এবং ত্যাগের প্রয়োজন। তবেই আমরা করোনার সঙ্গে বসবাসের সক্ষমতা লাভ করব।
বুঝতে হবে বড় বড় বিপর্যয় মোকাবিলা করার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হয়। সরকার থেকে নানা সুবিধা নিয়ে যেসব ব্যবসায়ী গ্রুপ আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক, তারা কোথায়? তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। যখন আমরা এমন একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকি, যেটি ব্যক্তি বা পরিবার দ্বারা মোকাবিলা সহজ, সেটির জন্য নিশ্চয়ই ব্যবসায়ী গ্রুপ বা সরকারের দরকার হয় না। কিন্তু এটি একটি মহামারি। এটিতে সাহায্য দরকার দেশের বিদেশের সবার।
পৃথিবীর আজ অন্যতম চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি- জলবায়ু সংকট। এটিও করোনার মত বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করার বিষয়। কোনও এক দেশ এটা মোকাবিলা করলেই যথেষ্ট নয়, বিশ্ববাসীকে ঝাপিয়ে পড়ে মোকাবিলা করতে হবে।
আসুন করোনাভাইরাস সংকট থেকে সঠিক পাঠগুলো শেখার সংকল্প করি, আমরা যা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তার ফলস্বরূপ আরও শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হয়ে সুন্দর দেশ ও আগামীর পৃথিবীকে গড়ে তুলব।
আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।