ফসিল সোসাইটি দেখে চমকে গেলেন। এটা আবার কেমন শব্দ, না চোখ কচলাতে হবে না, আপনি ঠিকই পড়েছেন। এতোদিনতো সিভিল সোসাইটি শুনে এসেছেন।
সমাজের জ্ঞানী গুণী মানুষরা সিভিল সোসাইটির পার্ট। তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং বিভিন্ন সংকটে রাষ্ট্রকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিবাদ করতেন। তখন কিন্তু একটা ঝাঁকুনি পড়ে যেত সমাজে। অনেক সময় সরকার বাধ্য হতো সরে আসতে।
আর ফেসবুক কেন্দ্রিক কল্পিত এই সোসাইটির নাম হচ্ছে ফসিল সোসাইটি। ফেসবুকের ফ আর সিভিল এর ভিল যোগ করলে ফভিল হয়। তাকে কিছুটা পরিবর্তন করে ফসিল সোসাইটি করলে পুরো সাদৃশ্য দেখতে পাই।
কঙ্কাল দীর্ঘদিন পতিত অবস্থায় থেকে পাথুরে রূপ নিলে তাকে ফসিল বলা হয়। কঙ্কালের যেমন সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে না, নড়াচড়া করতে পারে না। এই সোসাইটিও অনেকটা তাই। এ কথা শুনে অনেকের রক্ত মাথায় উঠে যেতে পারে। সিভিল সোসাইটির সদস্যরা সমাজের শ্রদ্ধেয় হলেও এই সোসাইটিতে কিন্তু গণস্বাক্ষরতা অভিযানের সুবিধাভোগীরাও রয়েছেন।
এই সোসাইটির একটা-দুইটা নজির সামনে তুলে ধরতে চাই। সাংবাদিক সমাজের মনে দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে রয়েছে সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ড। বেশ কয়েক বছর হলো এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল কিনারা হচ্ছে না। সাংবাদিকরা চান, প্রকৃত অপরাধীর সাজা। যাতে ভবিষ্যতে আর কাউকে এভাবে নিজ ঘরে প্রাণ দিতে না হয়। নিকট অতীতে এই একটি ঘটনার সম্মিলিতভাবে রাস্তায় নামতে পেরেছিলেন সাংবাদিক নেতারা।
সময়ের আবর্তে সেই আন্দোলনে ভাটা পড়ে যায়। খত কিন্তু এখনও বিদ্যমান। এখন মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছুটা হৈ-চৈ হয়। স্বভাবতই ফসিল সোসাইটির লোকজনও জাগ্রত হয়ে ওঠে। এ বছর ফেসবুকে দেখেই মনে পড়ে যায় দিনটির কথা। কতজনের কত আবেগঘন স্ট্যাটাস, পড়তে পড়তে চোখ যেনো ঝাপসা হয়ে আসছিল। আবার কতজনের আবেগী লেখাও খানিকটা ভেজা ভেজা লাগছিল। আহারে কত কষ্ট তাদের বুকে। স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে কয়েক বক্স টিস্যু শেষ করেছেন সেটা লিখতে ছাড়েননি কেউ কেউ। কারো আবার প্রতিবাদী লেখা, সবকিছু গুঁড়িয়ে হত্যাকারীর জান কবজ করে বাসায় ফিরতে চান।
কিন্তু দুপুরে ডিআরইউ’র সামনে জনা বিশেকের প্রতিবাদ সভায় সাবান ভাই, বাদশা ভাইরা যখন গলা ফাটিয়ে বিচার দাবি করছিলেন। সেই ফেসবুক ভেজানো এবং প্রতিবাদীদের কয়েকজনকে দেখলাম, কয়েক গজ দূরে বাগানে বসে চায়ের আড্ডায় মত্ত। আমি ভেবেছিলাম, কয়েক মুহূর্ত আগে যারা এমন আবেগী স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাদের চোখে মুখে হয়তো শোকের ছায়া কিংবা প্রতিবাদের অগ্নিমূর্তি দেখব। কিন্তু পুরোপুরি হতাশ হতে হলো। হাসি তামাশায় মগ্ন তারা।
যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন শুরু করল, তখন ফসিল সোসাইটিতে কান্নার রোল পড়ে গেল। বাংলাদেশের বর্ডার কেন খুলে দেওয়া হচ্ছে না সে নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে লানত দিতে থাকল। কেউ আবার ছেঁড়া কাপড়, চাল সংগ্রহ করে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাতে থাকলেন। এখন সেই লোকগুলোই ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাইছেন, কাজটি কিন্তু ঠিক হয়নি, বাংলাদেশ একটি ফাঁদে পড়ে গেছে।
এখন আসি করোনা প্রসঙ্গে, প্রথমে যখন হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করা শুরু হলো, তখন কতজনের কত কথা। আহা এই নেই কেন, ওই নেই কেন, রেডিসন হোটেল নয় কেন! আরে বাবা নদীতে তলিয়ে যেতে শুরু করলে কেউ পোটলা বাঁচানোর চেষ্টা করে না। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে জীবন বাঁচাতে চায়। তখন মোবাইলে পানি ঢুকল কিনা তা নিয়ে ভাবার সময় থাকে না। একটি গ্রুপ প্রথম দিকে ধোয়া তুলতে থাকল, ১৭ মার্চের আগে করোনা বাংলাদেশে ধরা পড়বে না। নানান তির্যক মন্তব্য। অবশ্য তাদের হতাশ করে কয়েকদিন আগে ৮ তারিখ করোনা ধরা পড়ে বাংলাদেশে। এখন তারা বলতে থাকেন, সংখ্যা নাকি সঠিক বলা হচ্ছে না। ভাবখানা এমন তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুনে দেখে এসেছেন।
ফসিল সোসাইটি কিন্তু বাংলাদেশের সীমানায় আবদ্ধ নেই। কেউ ট্রাম্প জয়ী হলে দ্রুত অভিনন্দন জানাচ্ছেন, আবার পুতিনকে পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ মোদিকে গালমন্দ করছেন, ট্রুডোকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। অবস্থা এমন যেন ট্রাম্প, পুতিন, ট্রুডো তাদের ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছেন।
ডিআরইউতে বসে আড্ডা দেবেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অ্যাসাইনমেন্টে যাবেন না। আরেক শ্রেণি পায়ের নাগালে নয়াপল্টনে না গিয়ে অফিস ফাঁকি দিতে পটু। তারা আবার নীতি বাক্য আওড়াতে সিদ্ধহস্ত। এডিটরদের জ্ঞান দিতেও পিছপা হন না। বলি উপদেশ অপেক্ষা দৃষ্টান্ত ভালো। ফেসবুকে নীতিবাক্য না আউড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আর কি বলছেন ভেবে বলছেন তো?
কয়েকদিন ধরে দেখছি তারা লকডাউন লকডাউন করে গলা ফাটাচ্ছিলেন। আবার লকডাউন হওয়ার পর রাস্তাঘাটে লোক দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গলাবাজি করলেন। পুলিশ যখন প্যাঁদানি দেওয়া শুরু করল তখন গেলেন বিগড়ে। আরে ভাই পুলিশ গোলাপ ফুল নিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলবে দুলাভাই আপনি রাস্তায় কেন? কথায় আছে, আটার সঙ্গে ঘুণও পৃষ্ট হয়। আপনি আপনার পরিচয় দেবেন না, কাজের কথা বলবেন না, ভাব নিয়ে থাকবেন আপনি অমুক মাননীয়র নাতি। তাহলেতো হস্তক্ষেপ কিংবা পদক্ষেপ নেওয়াই উচিত। তাদের সেভাবেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে মাঠ পর্যায়ে অতি উৎসাহীদের কর্মকাণ্ড সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলে।
গণহারে যখন মানুষ ঢাকা ছাড়া শুরু করলেন, তাদের কতজনের মায়াকান্না। আহা দেশ গেল দেশ গেল। কয়েকদিন পরে তাদেরই কাউকে দেখছি নিজ গ্রামে বদনখানি উঁচু করে ছবি দিচ্ছেন। ও তাহলে আপনি গেলে ঠিক, অন্যরা গেলে নাজায়েজ?
এক শ্রেণি বলতে শুরু করেছে, অনেকদিন সময় পেলেও বাংলাদেশ কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। প্রবাসীদের দেশে আসতে দিল কেন। কতশত প্রশ্ন। আপনার ভাইকে দেশে ঢুকতে না দিলেতো লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিতেন। সময়তো কানাডা, ইতালি, আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোও পেয়েছে। তারা কি করেছে? এই প্রশ্ন ট্রাম্পকে করেন না কেন? ট্রাম্প না আপনার স্ট্যাটাস দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে! সেন্টিমিটারের সঙ্গে গ্যালনকে গুলিয়ে ফেলেন কেন?
এর মধ্যেও যে কিছু ভালো নেই তা কিন্তু নয়। অনেকের কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কিছু রয়েছে ঐতিহাসিক শিক্ষাও। কিন্তু বেশিরভাগ হুজুগে বাঙালি। এদের কথায় কান দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ভালোর চেয়ে মন্দ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবার এক শ্রেণির মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শের। কেউ মনে করেন শেখ হাসিনা ভুল করতেই পারেন না। আবার আরেক শ্রেণির লোক মনে করেন খালেদা জিয়াতো ফেরেশতার কাছাকাছি।
বৈদেশিক নীতি নিয়ে তাদের কম পরামর্শ নেই। পৃথিবী থেকে বারিমণ্ডল সবই তাদের নখদর্পণে। কোথাও কোনো পেইড বুদ্ধিজীবীর একটা বক্তৃতা শুনেছেন, তার তলা না হাতিয়ে সমাজকে জ্ঞান দিতে নেমে পড়েছেন। এই ফসিল সোসাইটি লইয়া কি করিব হায়!
সেরাজুল ইসলাম সিরাজ: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম