সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গত শুক্রবার (২৭ মার্চ) একটি ছবি ভাইরাল হয়। দু’জন বয়স্ক মানুষ কান ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, আর একজন নারী তার ছবি তুলছেন। সঙ্গে পুলিশও আছেন। পরে জানা গেল যিনি ছবি তুলছেন তিনি একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান।
শুক্রবার বিকেলে তিনি উপজেলার চিনেটোলা বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। সেখানেই এই দুই প্রবীণ নাগরিককে আটক করেন। একজন সবজি বিক্রি করছিলেন। অপরজন সাইকেল চালিয়ে বাজারে আসেন নিত্যপণ্য কিনতে। মাস্ক না পরার অপরাধে সাইয়েমা তাদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। আরও একজন ভ্যানচালককেও একই অপরাধে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন।
দু’জন প্রবীণ মানুষ কান ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, এই ছবিটি দেখে অপমানে আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি। মানুষ ধনী হতে পারে, গরীব হতে পারে, শিক্ষিত হতে পারে, অশিক্ষিত হতে পারে, কালো হতে পারে, সাদা হতে পারে, নারী হতে পারে, পুরুষ হতে পারে। কিন্তু মানবিক মর্যাদা সবার সমান। সেই মর্যাদা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
তারচেয়ে বড় কথা হলো, দেশে কিন্তু কোনো কারফিউ নেই, কোনো লকডাউনও নেই। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সবকিছু বন্ধ করে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতা দিবস থেকে দেশ কার্যত স্থবির। করোনা আতঙ্কে সবাই ঘরে ঢুকে পড়েছেন। তবুও জীবন থেমে থাকে না। কিছু মানুষকে ঘর থেকে বেরুতেই হয়। কিন্তু খবর পাচ্ছি গত দুদিনে ঘর থেকে বেরুনো মানুষের সাথে পুলিশ
দুর্ব্যবহার করেছে, লাঠিপেটা করেছে। কেন? তাদের অপরাধ কী?
মনিরামপুরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনই এসিল্যান্ড সাইয়েমা হাসানের বাবার বয়সী। বিনা অপরাধে তাদের এমন অপমান করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? দেশে কী ঘর থেকে বেরুনো নিষিদ্ধ, দেশে কী মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক? এটা ঠিক সবাই ঘরে থাকলে করোনা বিস্তার রোধ সহজ হবে। ঘর থেকে বেরুলে মাস্ক ব্যবহার করলে ভালো। কিন্তু বাধ্যতামূলক তো নয়।
সাইয়েমা হাসান তাদের বোঝাতে পারতেন। সাইয়েমা হাসান কি একবারও খোঁজ নিয়েছেন, এই দরিদ্র মানুষগুলোর ঘরে খাবার আছে কিনা? তাদের মাস্ক কেনার টাকা আছে কিনা? সাইয়েমারা নোট বই মুখস্ত করে বিসিএস দিয়ে বড় অফিসার হয়েছেন, এই সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হতে পারেননি। কয়েকদিন আগে কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভিন সাংবাদিক পিটিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। এখন সাইয়েমা হাসান এলেন আলোচনায়।
প্রথম কথা হলো, আমি এই দুইজন কর্মকর্তাকে দিয়ে প্রশাসনকে মাপতে চাই না বা প্রশাসনের সবাই অমানবিক, ঢালাও এমন অভিযোগও আমি করছি না। প্রশাসনে অনেক অসাধারণ মানবিক কর্মকর্তার দেখা
পেয়েছি আমি। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, প্রশাসনের নিচের দিকের কর্মকর্তারা এত অ্যারোগ্যান্ট কেন? এটা কি বয়সজনিত উত্তেজনা, অপরিপক্বতা নাকি প্রশিক্ষণের ঘাটতি। আমি মনে করি মাঠে নামানোর আগে কর্মকর্তাদের আরও বেশি মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। ভালো করে বোঝাতে হবে যে তারা জনগণের
শাসক নয়, সেবক।
সুলতানা পারভিন এবং সাইয়েমা হাসানের ঘটনার পর আরেকটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, নারীরা অনেক বেশি দক্ষ, সময়ানুবর্তী, শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং মানবিক। কারণ তাদের মধ্যে মাতৃরূপটা সহজাত। কিন্তু এই দুজন আমার সেই বিশ্বাসে হালকা ধাক্কা দিয়েছেন। যদিও টলাতে পারেননি। আমি ধরে নিচ্ছি এই দুজনই ব্যতিক্রম। আমি এই ব্যতিক্রম
দিয়ে প্রশাসনকে মাপবো না, নারীদেরও বিবেচনা করবো না।
সাইয়েমা হাসানকে আপাতত প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারপরও আমি মনে করি, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। যাতে প্রশাসনের বাকি সবাই বোঝে যে, মানবিক হওয়াটা সবার আগে দরকার। প্রয়োজনে তিনি কঠোর হবেন, তবে সেটা হতে হবে আইনানুগ।
সাইয়েমা হাসানের বাড়াবাড়ির খবর যেমন ভাইরাল হয়েছেন, তেমনি একই অভিযোগ এসেছে পুলিশের বিরুদ্ধেও। দেশের কোনো কোনো এলাকায় ঘর থেকে বেরোনো বা মাস্ক না পরার ‘অপরাধে’ পুলিশ অনেককে লাঠিপেটা করেছে, অপমান করেছে। সিনিয়র সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু লিখেছেন, ‘করোনা স্বাস্থ্য
সমস্যা। কিন্তু পুলিশ আর প্রশাসন এটিকে আইনশৃঙ্খলা সমস্যা বানিয়ে ফেলেছে।‘ অপ্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। কিন্তু যার সত্যি সত্যি প্রয়োজন তাকে তো ঘর থেকে বেরুতেই হবে। বাজার করতে বেরুতে হবে, ঔষধ কিনতে বেরুতে হবে, কাউকে কাউকে জীবিকার তাগিদেও বেরুতে হবে। পুলিশ তাদের বুঝিয়ে ঘরে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু কারো গায়ে হাত তোলার কোনো অধিকার কারো নেই।
১৬ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর যখন মানুষ দল বেধে কক্সবাজার চলে গেল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর যখন মানুষ ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে গাদাগদি করে ঈদের ছুটির মত বাড়ি ফিরলো, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন। আর এখন এসেছেন মাস্তানি দেখাতে। এরই মধ্যে অনেক পুলিশের অনেক মানবিক উদ্যোগের খবর আমরা জেনেছি। তারা দরিদ্রদের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু কারো কারো বেআইনি ও উদ্ধত আচরণ পুলিশ ও প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এখন মানবিক সংকটকালে আমাদের আরও মানবিক হতে হবে। সবাইকে সবার পাশে থাকতে হবে। পুলিশের আইজি যেখানে পুলিশ সদস্যদের বিনয়ী হতে বলছেন, সেখানে তারা কেন এত আক্রমণাত্মক হচ্ছেন।
আমরা চাই সবাই ঘরে থাকুক, নিরাপদে থাকুক। এটা শুধু আমাদের সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। এই দুঃসময়ে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ঘটনাও না ঘটে। কেউ যেন বাড়াবাড়ি না করে। কোথাও যেন মানবতা ভূলুণ্ঠিত না হয়। মানবতার জয় হোক।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ