করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসরণ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর | 2023-09-01 14:07:09

বিশ্বখ্যাত ‘ন্যাচার’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষকদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী মেটাজেনোমিক সিকুয়েনসিংয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ চীনের স্তন্যপায়ী প্রাণী প্যাঙ্গোলিনে SARS-CoV-2 সম্পর্কযুক্ত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এবং দুনিয়াব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারি আকারে বিস্তারে প্যাঙ্গোলিনকে সম্ভাব্য হোস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ হলো করোনাভাইরাস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক সদস্য ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কোভিড-১৯ কে এরইমধ্যে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

কোভিড-১৯ প্রথমে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের উপরাংশে, পরবর্তীতে শ্বসনতন্ত্রের নিম্নাংশে ফুসফুসে আক্রমণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণগুলো হচ্ছে, জ্বর, ক্লান্তি ও খুসখুসে শুষ্ক কাশি। কোভিড-১৯ আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্দি, গলা ব্যথা, নাক কনজেশন, শ্বাস কষ্ট এবং শরীরে ব্যথা বা ডায়রিয়া দেখা যায়। কারও স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়ার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। চীনে Covid-19 দ্বারা মানুষের ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে "ভাইরাল নিউমোনিয়া" প্রাদুর্ভাব চলমান আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আক্রান্ত ছয় জনের একজন মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের কোভিড-১৯ দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার বিশাল ঝুঁকি রয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যে কোনো বয়সের লোকই নতুন এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে।

ডব্লিইএইচও এর প্রদত্ত তথ্য মতে, যেহেতু ভাইরাসটি নতুন, সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা এখনও সম্ভব নয় যে, গরম- স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এই ভাইরাস বাঁচে না। বরঞ্চ এখন পর্যন্ত যেসব প্রমাণ বিজ্ঞানীদের হাতে রয়েছে, তাতে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো আবহাওয়াতেই কোভিড-১৯ ভাইরাস বিস্তারের ক্ষমতা রাখে।

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মতো শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণকারী ভাইরাসগুলো তখনই ছড়ায় যখন তা নাক বা গলার শ্লেষ্মার মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হাতের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমণের প্রধান মাধ্যমও হাত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য ইতোমধ্যে নিম্নোক্ত তিনটি উপদেশ দিয়েছে।

১. কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধের সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর উপায়গুলোর একটি হল ঘনঘন সাবান বা অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া। কারণ সাবান বা অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার মানুষের হাতে থাকা করোনাভাইরাস নির্মূল করে।

২. মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করে শ্বসন স্বাস্থ্যবিধি পালন। কারণ মাস্ক ব্যবহারের মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির ভাইরাস ধারণকৃত তরল ড্রপলেট থেকে রক্ষা পাওয়া অনেকাংশে সম্ভব।

৩. অন্য মানুষ থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখা। কারণ কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিলে মুখ ও নাক দিয়ে তরল ড্রপলেট নিঃসৃত করে যা ভাইরাস বহন করে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির উক্ত ড্রপলেট নিকটবর্তী ব্যক্তি শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণের ফলে আক্রান্ত হতে পারে।

দুই মাস আগে এই মারণ ভাইরাসের আঁতুড়ঘর চীনের হুবেই প্রদেশে হলেও, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশগুলো (ব্যাপকভাবে পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক দূরত্ব বাড়ান) অনেক দেশ অনুসরণ না করায় বর্তমানে কোভিড-১৯ সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এশিয়া থেকে এ প্রাদুর্ভাব ইউরোপ ও আমেরিকায় বিস্তার লাভ করেছে। অনুমান করা যায়, এই মরণ ভাইরাসের পরবর্তী ঢেউ আফ্রিকায় আঘাত হানবে।

জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ব্যক্তিগত ডাক্তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে ম্যার্কেলকে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিশ জনসন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন। কোয়ারেন্টাইনের অর্থ সকলেই জেনে গেছে বা জানে, তা হলো-রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় পৃথক রাখা।

করোনাভাইরাস ও কোয়ারেন্টাইন শব্দ দুইটি বর্তমানে ব্যাপক আলোচিত সমার্থক শব্দদ্বয়। চীনের কোভিড-১৯ ক্লিনিকাল বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ঝাং ওয়েনহং বলেন, কম সময়ে এ ভাইরাসের সমাধান করতে হলে চীনের মতো অনেক কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। চীন নববর্ষের ছুটি বাড়িয়ে শহরগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই বন্ধ ছিল চীনে।

রসায়নে নোবেলজয়ী জীবপদার্থ বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিট বলেন, যেসব দেশ ও অঞ্চল সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে সেখানে বড় প্রভাব ফেলতে পারবে না কোভিড।

ব্রিটিশ ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী বরিশ জনসন (বর্তমানে কোভিড-১৯ আক্রান্ত) ২৯ মার্চ, ২০২০ তারিখে প্রত্যেক ব্রিটিশ পরিবারকে করোনাভাইরাস "জাতীয় সংকটকালে" ঘরে থাকার আর্জি জানিয়েছেন। বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী বিল গেটস ২৫ মার্চ, ২০২০ তারিখে টিইডি ডট কম-এর কিউরেটর এন্ডারসনকে বলেছেন, যদি তিনি এখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতেন, তবে তিনি কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধে মানুষকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন) রেখে ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ অগ্রাধিকার দিতেন। বিল গেটস আরও বলেছেন, চীনের ক্ষেত্রে তা ছয় সপ্তাহ ছিল এবং আমাদেরকে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভালোভাবে করতে হবে।

নিম্নের গ্রাফটি হলো সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ এবং যে কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমিত সাধ্যের মধ্যে ধরে রাখার মূলনীতি। খাড়াভাবে বৃদ্ধি পাওয়া কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা দেখে বোঝা যায়, তা দেশগুলোর বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামর্থ্যকে অতিক্রম করে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রতিদিন এই সংখ্যাটি ১১ থেকে ১৭ হাজারে ওঠানামা করছে; ইতালিতে এই খাড়া বৃদ্ধির সময়কালে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজার আক্রান্ত হয়েছে, চীনে সবচেয়ে খারাপ দিনে প্রায় ১৪ হাজার আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গ্রাফ

তবে পরে লকডাউন কার্যকর করা হলে সংক্রমণের সংখ্যা কমতে শুরু করে। গ্রাফের সমতল ঢাল নির্দেশ করছে একই সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবে কিন্তু ধীর গতিতে। তাতে করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিজেদের ওপর চাপ না নিয়ে এবং সীমিত সরঞ্জামের মাধ্যমে সব রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ হ্রাসকারী/বিচ্ছিন্নকারী পদক্ষেপ নিয়ে সংক্রমণের গতি কমানো যায়। তাতে করে মৃত্যুহার কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং হংকং "ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ" অনুসরণ করে "গতিপথ পাল্টে দেওয়ায়" সফলতা পেয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ-নির্ভর পরামর্শ ও সুপারিশসমূহ বিশ্বকে যোগান দিয়েছে এবং কার্যকরভাবে সকল দেশের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মরণ ভাইরাসের মোকাবিলায় পালিত মুখ্য ভূমিকা অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। সকল দেশের সরকার ও জনগণের উচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও সুপারিশসমূহ সমর্থন ও অনুসরণ করে এই মহামারীর কবল থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা।

প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর: অধ্যাপক, ক্রপ সায়েন্স ও টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর