আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার করোনাভাইরাসকে চাইনিজ ভাইরাস বলে অভিহিত করেছেন। এর ভেতরে রাজনীতি থাকলেও ভাইরাসের উৎপত্তিগত সত্যতাও রয়েছে। চৈনিক এ ভাইরাস আজ গ্লোবাল ভাইরাসে রূপ নিয়েছে। আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। ফলে অন্যান্য দেশ এ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে আমরাও সে ব্যবস্থাই নিচ্ছি। ওরা হোম কোয়ারেন্টাইন, সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ইত্যাদি করছে। আর আমরা ঘরে বসে সঙ্গরোধ করছি। জানা মতে, সঙ্গরোধ ছাড়া এর আর কোনো প্রতিরোধ নেই। প্রতিকারও হাতে নেই। কাজেই ঘরে বসে থাকাই নিরাপদ। শুধু আমরাই নয়, পুরো বিশ্ববাসীই আজ ঘরবন্দি।
আমাদের দেশে একঘরে করে দেয়া কথাটা এক সময় বেশ প্রচলিত ছিল। সমাজ অনেককে একঘরে করে দিতে। তার সঙ্গে কেউ লেনদেন করতো না। মেলামেশা করতো না। চৈনিক এ ভাইরাসটি আজ শুধু বাঙালিদেরই নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীকেই একঘরে করে রেখেছে এবং সবাইকে নিজে থেকেই এক ঘরে করে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে।
ঢাকার আগে অন্তত আরও ১২০টি দেশে করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে। কিন্তু আমরা বাঙালি তখনও একঘরে হয়ে বসে ছিলাম। শেষে যখন সত্যি সত্যি করোনার রোগী পাওয়া গেল তখন দেখা গেল আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। কিন্তু এর আগে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা অবশ্য সব সময়ই যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকি। এই যে করোনা আক্রমণ করেছে, রোগী মারা যাচ্ছে আমরা কি অপ্রস্তুত হয়ে গেছি? যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেয়াটাই বড় কথা। পরিস্থিতি সামলে আমাদের নেয়াতে জুড়ি নেই!
আমাদের বঙ্গ সন্তানদের মাঝে আরেকটি বিষয় কাজ করে। তা হচ্ছে আমরা একজন আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পছন্দ করি। ব্যক্তিগত বিষয়ে আমরা যেমন একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাই, তেমনি জাতীয় ইস্যুতেও আমরা দোষ চাপাই সরকারের ঘাড়ে। ডেঙ্গু হয়েছে-সিটি করপোরেশনের দোষ। আগুন নেভাতে দেরি-ফায়ার সার্ভিসের দোষ। ম্যানহোলের ঢাকনা দিয়ে শিশু পড়ে গেছে-ওয়াসার দোষ। কিন্তু কখনো ভাবি না, আমাদের বাড়ির উঠান, বৈঠকখানা সিটি করপোরেশন এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে না। সরুগলি মাড়িয়ে উৎসুক জনতার ভীর ঠেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কেন আসতে পারলো না সে জন্য ডিজি (ফায়ার)-এর চাকরি যায় যায় অবস্থা। ম্যানহোলের ঢাকনা চুড়ি রোধে ওয়াসার চেয়ারম্যান কেন চৌকিদার ও টর্চ লাইট দিয়ে পাহাড়া দিলো না সে জবাবদিহিতা তাকেই করতে হবে। পাঠক ভাবছেন, চৈনিক ভাইরাসের বয়ান করতে গিয়ে কেন আমরা বঙ্গ সন্তানদের মুন্ডপাত করছি। ফার্মগেট ওভার ব্রিজ বা গুলিস্তান আন্ডার পাসের চারদিকটা যখন এই লাজুক বঙ্গ সন্তানদের মুত্রপাতে সয়লাব হয়ে যেতো তখন মানতে বাধ্য হই, রবিঠাকুরের বঙ্গমাতা কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। পার্থক্য শুধু তখন ছিল ৭ কোটি বাঙালি, আর আজ তা ১৭ কোটি।
বিশ্ব বাংলা বলতে একটা কথা আছে। বাঙালি আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। কিন্তু এর আরেকটা অর্থ অনেকেই করে থাকেন। কোনো জাপানি বাংলাদেশে এলে বাংলাদেশি হয়ে যান, আর কোনো বাঙালি জাপানে গেলে জাপানকে বাংলাদেশ বানিয়ে ছাড়েন। ইতিবাচক, নেতিবাচক যে অর্থেই বলি না কেন, বাঙালির বিশ্ব জয় থেমে নেই। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের আজও জয় করতে পারিনি। ফলে, ২ কোটি মানুষের শহরে ২৫টা বেসিন বসিয়ে মেয়র কেন ঠাট্টা মশকরা করলেন তার বিচার করি, কিন্তু হাত ধুয়ে খাওয়া যে একটি স্বাভাবিক মনুষ্য আচার তার বিচার কে করবে?
আমরা আসলে বাস করি এক দূষণযুক্ত সমাজে। এখানে পানি দূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দ দূষণ, খাদ্য দূষণ, দৃশ্য দূষণ- এরকম হাজারো দূষণের মাঝেই আমাদের বসবাস। রাজধানীর অভিজাত এলাকার কোনো অলি-গলিতেও গেলেও দেখতে পাই মরা কুকুর-বিড়ালের ছানা, কলার চোছা, কাঁঠালের ভূতি আরও কতো কি। যানজট, মশা, আবর্জনা, জলাবদ্ধতা, এসব হাজারো সমস্যা নিয়ে পেরেশান আমরা ঢাকাবাসী। কিন্তু তারপরও আমরা ভালো আছি। ঢাকার কঠিন বায়ুর মাঝেও আমাদের আয়ু বাড়ছে বৈ কমছে না।
করোনার আঘাতে যখন বিশ্বের প্রায় অর্ধেক দেশ পর্যুদস্ত, তখন আমরা ভেবেছিলাম করোনা আমাদের কিছু করতে পারবে না। কারণ, সারা বছরই আমাদের জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, ডায়রিয়া, ডেঙ্গু লেগে থাকে। এসবের মধ্যে করোনা এসে সুবিধা করতে পারবে না। আমরা ভেবেছিলাম ঢাকায় যে জীবন আমরা যাপন করি তাতে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। ফলে সামান্য ঠাণ্ডা, জ্বর বা গলা ব্যথা এখানে হালে পানি পাবে না। আইইডিসিআর এর হিসাব অবশ্য আশাব্যঞ্জকই। দেশে আক্রান্তের হার কম। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে মাত্র ২ জন আক্রান্ত হয়েছে। গত ২০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৫৬ জন। মারা গেছে ৬ জন। সব কিছুর হারই কম।
আমরা ভেবেছিলাম ঢাকা যে জনবহুল নগরী তাতে এখানে ভাইরাস একবার ছড়িয়ে পড়লে তাকে আর ঠেকানো যাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণেই আছে বলে মনে হয়। এটা আশার কথা। তবে আরও আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে হয়তো গোড়াতেই করোনাকে শতভাগ রোধ করা গেলেও অনেকটাই রোধ করা যেত। এখন সতর্কতা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ঘরে বসে থাকাটাই এখন সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধের উপায়।
ইতোমধ্যে বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান ও মাস্কের চাহিদা আকাশচুম্বী। এসবই সময়োপযোগী। কিন্তু যে কথা দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম-পরিচ্ছন্নতা কি কোনো মৌসুমি আচার? বাইরে থেকে ঘরে এসে হাত পা ও মুখমণ্ডল ধোয়াতো একটি নিয়মিত আচার হওয়ার কথা। এছাড়া আমাদের ঢাকায় যে পরিবেশ তাতে এটাতো অবশ্য পালনীয় একটি বিষয়। কিন্তু আমরা কি তা করছি? আমাদের ঘরের চারপাশটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাতো একটি ন্যূনতম নাগরিক ও সামাজিক দায়িত্ব। কিন্তু বাড়ির উঠানের ময়লা সিটি করপোরেশন পরিষ্কার কেন করলো না তা নিয়ে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। ঢাকার রাস্তাঘাটে যে অবস্থা ভাবা যায় একটি দেশের রাজধানীর সড়ক এতো নোংরা হতে পারে? ভিআইপি সড়ক বাদে ঢাকার পুরো রাস্তা জুড়েই বাজার বসে। ফুটপাতও বাজারের দখলে। এ নিয়ে রাজনীতিও কম হয়নি। কিন্তু ঢাকার সড়ক এখনও আগের মতোই নোংরা এবং বেদখল। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলতে আমাদের একটুও বাধে না। থুথু, পিক, কফে সয়লাব ঢাকার রাস্তা, আমাদের চারপাশ। এভাবে চলতে পারে না।
কোনো দুর্যোগই চিরদিন থাকে না। রোগ, শোক, বালা-মুসিবত আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে শহর। এই অন্ধকার কেটে গেলে আমরা হয়তো আবার ঢাকায় ছড়িয়ে পড়বো আগের মতোই। কিন্তু আমাদের ভালোভাবে বাঁচার জন্য এই শহরকেও বাঁচতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শহরের জীবন আছে। তাকেও দম নিতে হয়। তবেই আমরা দম পাবো। করোনা আমাদের সঙ্গোপনে অনেক কিছুই শিখিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো ধরতে পারাটাই কাজ। একটি পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর জীবনই যেনো করোনার শিক্ষা।
এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট