‘অ্যাম্বুলেন্সে ১৬ ঘণ্টায় ৬ হাসপাতালে ছোটাছুটি, অতঃপর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু’ শিরোনামে একটি খবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। যিনি বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য তার সন্তানরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিবেদনটি বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দৃশ্যমান করে তুলেছে।
বর্তমানে যে হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে না সেগুলোর হিসেব সরকারের জানা। তারপরও সরকার হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি বাধ্যতামূলক করতে পারেনি। এ রকম অনেক খবরই এখন বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। অনেকেই ভাবছেন করোনার চেয়েও বেশি মানুষ মারা যাবে বিনা চিকিৎসায়।
সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে রোগী ভর্তি করার ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কোনো কারণ ছাড়াই রোগী ভর্তি না করালে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মারা যাবেন এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একইসঙ্গে মেনে নেওয়া যায় না যথাসময়ে ডাক্তারের পিপিই (পার্সোনাল প্রটেশন ইকুইপমেন্ট) দিতে না পারাটা।
চিকিৎসার যেমন নিরাপদ পরিবেশ চাই তেমনি চিকিৎসকরা যথাসাধ্য সেবা দেবেন এটাও আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত বিসিএস ক্যাডারের নাম স্বাস্থ্য ক্যাডার। তাদের অনেক বঞ্চনা আছে। কিন্তু সেই বিতর্ক করার সময় এটি নয়। বরং সবচেয়ে মানবিক সেবা প্রদানকারী পেশা চিকিৎসা সেটারই প্রতিফলন চাই।
যখনই কোনো দুর্যোগ আসে তখন অনেকগুলো বিপদ একসাথে হাজির হয়। বাংলাদেশে সংকট আরও কত দিকে তীব্র হবে সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গোটা বিশ্ব দিশেহারা। উন্নত দেশগুলোও সংকট মোকাবিলায় হাবুডুবু খাচ্ছে। অনেক দেশে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা যে কত নাজুক ইতোমধ্যে সেটাও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ সরকার যে কতখানি চিকিৎসা দিতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে এখনো অনেকখানি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। দেশের প্রত্যেক জেলাতেই অনেকগুলো বেসরকারি হাসপাতাল আছে। এগুলো থেকে বাছাই করে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য সরকার গ্রহণ করতে পারে। যে ক্লিনিক/হাসপাতাল সরকার গ্রহণ করবে সেগুলোর যে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সহায়তা দানকারী ব্যক্তি আছেন তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।
বিভাগীয় শহরগুলোতে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল আছে। যেখানে একাধিক সরকারি হাসপাতাল আছে সেগুলোর একটি করে আপাতত করোনা ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
রংপুরে মা শিশু হাসপাতাল যেটি নির্মাণ করা হয়েছে এখনো উদ্বোধন হয়নি সেটাকে আপাতত করোনা ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রংপুরে যদি আরও বড় হাসপাতাল প্রয়োজন হয় তার জন্য রংপুরেই বেসরকারি বড় বড় হাসপাতালও আছে। শুধু তাই নয়। জেলাগুলোতে অনেক আবাসিক হোটেল আছে। উপযুক্ত হোটেলও সরকার গ্রহণ করতে পারে। হোটেলগুলোতে আইসোলেশন সেন্টার ভালো হবে।
বেসরকারি উদ্যোগে নতুন করে হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর চেয়েও সহজ হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়া।
সরকারিভাবে যে দক্ষ জনগোষ্ঠী আছে তা দিয়ে যদি করোনা আক্রান্তদের সেবা দেওয়া না যায় তাহলে স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশে এখন প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। এসব সংগঠনে দক্ষ তরুণেরা কাজ করছে। প্রত্যেক জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে এদের তালিকা করা অত্যন্ত জরুরি। এদেরও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে চিকিৎসা সেবার কাজে লাগানো সম্ভব।
রংপুরে ‘উই ফর দেম’ নামে একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা করোনা সতর্কতায় অনেক রকম কাজ করছে। জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে। সাধারণ জনগণকে সতর্ক করছে। আবার সারা রাত ধরে অতিরিক্ত ফি গ্রহণ না করে ন্যায্য মূল্যে বাড়ি বাড়ি ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে। মেয়েদের মাসিককালীন প্যাড বিনামূল্যে পৌঁছে দিচ্ছে। ‘উই ফর দেম’ এর প্রতিষ্ঠাতা তরুণ সংগঠক জীবন ঘোষ বলেন- ‘আমরা করোনা রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি।’
‘করোনা’ আসার আগেও দেশে প্রতিদিন লাখ লাখ রোগী ছিল যাদের সর্দি, জ্বর, গলাব্যাথা, শ্বাসকষ্ট আছে। এই রোগীদের কী এখন আর চিকিৎসা হবে না? আমার এক সহকর্মী ভীষণ বিপদে পড়েছিলেন তার তিন বছরের বাচ্চার চিকিৎসা নিয়ে। যে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে সন্তানের চিকিৎসা করাতেন তার সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেননি। শেষে ফোনে ফোনে চিকিৎসাপত্র নিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। তবে অনেক বেসরকারি হাসপাতালে মাতৃসেবা চালু আছে।
বিভাগীয় পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ আছে কিনা সেই পরীক্ষা করার যন্ত্র পাঠানো হয়েছে। কোথাও কোথাও কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ মাসেই মোট ২৮টি পরীক্ষণ যন্ত্র স্থাপন হবে মর্মে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। এই যন্ত্র জেলা পর্যায়ে পাঠানো প্রয়োজন। চিকিৎসকদের কাছে জোর অনুরোধ আপনারা রোগীর শ্রেণিবিন্যাস করে সেবা নিশ্চিত করুন।
সারাদেশে ব্যক্তিগত চেম্বার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার সময় অন্য সব রোগ বন্ধ হয়ে গেছে এমন তো নয়। তাহলে উপায় কী?
একদিকে ক্ষুধা অন্য দিকে চিকিৎসাহীনতা এ দুটো কি করোনার ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে যাবে? ক্ষুধা নিবারণে বিত্তবানেরা এগিয়ে এলে সমস্যা হয়তো সমাধান হবে। কিন্তু চিকিৎসরা যদি চিকিৎসা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
সরকারি চিকিৎসকরা চাকরিজনিত কারণে চিকিৎসা দেওয়ার কাজে যুক্ত আছেন। বেসরকারি চিকিৎসকরাও যাতে সেবা দেওয়া থেকে বিরত না থাকেন সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় দুর্যোগে চিকিৎসকদের যথাসাধ্য অংশগ্রহণ থাকলে দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।
তুহিন ওয়াদুদ (শিক্ষক), বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল