জানি অভিমান নয়, অনেকে রাগ করবেন। কারো অভিমান বা রাগকে তোয়াক্কা করার অভ্যেস নেই। এই অভ্যেস আপনাকে থামিয়ে দেবে। আমরা তো থেমে যেতে চাই না। তাই রাগ করলেও বলছি- আম মানুষ যেই পেশাজীবীদের গালমন্দ করতেন, যাদের সেবায় তুষ্ট হতে পারতেন না, সেই পেশাজীবী মানুষেরাই কিন্তু এখন রণক্ষেত্রে। মানুষের পাশে। আম মানুষের নিরন্তর অভিযোগ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। ভুল চিকিৎসা দেন। রোগীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ দেন। কমিশন খান ওষুধ কোম্পানি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে। আছে অদক্ষতা। তাই রোগীকে বিদেশ যেতে হয়।
এই অভিযোগগুলোর সাফাই গাইছি না। কোনো কোনো চিকিৎসক এই অভিযোগগুলোর জন্য সত্যিই দায়ী এবং এমন অসাধুতার সঙ্গে জড়িতও বটে। কিন্তু সংখ্যায় তারা নগন্য। যেমন নগন্য এই কোভিড-১৯ এ মানুষের সেবা দেয়া থেকে দূরে সরে থাকা চিকিৎসক। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সম্মুখ যোদ্ধা এখন চিকিৎসকরা। সঙ্গে আছেন নার্সরাও। এই নার্সদের সেবা নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু এখন নিজের জীবন তুচ্ছ করে, পরিবারের কথা না ভেবে যুদ্ধের মাঠে তারাই।
পুলিশের বিরুদ্ধেও দিস্তায় দিস্তায় অভিযোগ। মিথ্যে মামলা, হয়রানি এবং ঘুষের অভিযোগ আছে। পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হলেও, সেই বন্ধুত্বের নিদর্শন পাওয়া যায় না। অভিযোগগুলো মিথ্যে নয়। পুলিশ বিভাগও এ ধরনের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নিজেদের শোধরানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও পুরোপুরি পরিশোধন করা যায়নি। এই পরিশোধন অযোগ্যে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা কতো? এখানেও কতিপয়ের আচরণের দায় পুরো বাহিনীকেই নিতে হয়। নিতে হচ্ছে। কিন্তু কোভিড-১৯ এ যখন সাধারণ ছুটি বা লকডাউন করা হলো বিভিন্ন এলাকা এবং রাষ্ট্র, তখন নিকট সকল সময়ের চেয়ে পুলিশকে সর্বোচ্চ সক্রিয় দেখা গেছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছেন না, আমরা দেখছি, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কাছে নীরবে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। হটলাইনে কেউ ফোন করলেই পুলিশ তার দরজায় বাজার বা খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকালে পুলিশকে জনগণ বন্ধু হিসেবেই পাশে পাচ্ছেন।
অভিযোগ আছে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও। সঠিক খবর দেয়া হয় না। ক্ষমতার কথা বলে। জনগণের কথা বলে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অভিযোগও মিথ্যে নয়। কিন্তু এখন নানা বিভ্রান্তির মধ্যে ঠিক খবর দিতে, মানুষকে সচেতন করতে মাঠে, বার্তাকক্ষে সক্রিয় গণমাধ্যম কর্মীরা।
এর বাইরে দেশে আরো অনেক পেশাজীবী আছেন। কোভিড-১৯ এর মহারণের সময়ে তাদের সাড়া নেই। তাদের যে যুদ্ধের মাঠে নামতে হবে তা নয়। কোভিড-১৯ এর এই দুর্যোগে দেশের কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে যাচ্ছে, কর্মহীন হওয়ার শঙ্কায় পড়ে গেছেন লাখ লাখ মানুষ, আয়ের উৎস অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কোটি মানুষের। অর্থনীতির এই মন্দা বা চ্যালেঞ্জকে কি করে মোকাবিলা করবে বাংলাদেশ? এই যে চিকিৎসা ব্যবস্থা চলছে, সেখানে নানা অবকাঠামো সংকট বা ঘাটতি রয়েছে, সেখানে নিজেদের মেধা বিনিয়োগ করতে পারেন, এমন পেশাজীবীর সংখ্যা কম নয় দেশে। কিন্তু তাদের কোনো উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। প্রকৃত অর্থেই হয়তো তারা সামাজিক দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা রক্ষা করে চলেছেন।
ভাত ঘুমে থাকা এই পেশাজীবীদের আবার তৎপর দেখা যাবে কোভিড-১৯ সংকট কেটে যাওয়ার পর। তখন অর্থনীতিসহ নানা অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় এবং বৈদেশিক প্রণোদনা বা সহায়তা আসতে পারে। সেখানে হাত বাড়াতে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে মুখর হবেন তারা। গবেষণা, জরিপ, প্রকল্প, সেমিনারের ঘাটতি থাকবে না। এমন বেশ কয়েকজন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তাদের কথায় মনে হয়েছে- এ ধরনের সংকট তাদের সিলেবাসে ছিল না। তাই সংকটে সহায়তা বা সংকট থেকে উত্তরণের কোনো উত্তর দেয়ার সাধ্য তাদের নেই। কারণ তারাও পেশায় টিকে আছেন কতিপয় দাতা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ‘মেথড’ আঁকড়ে।
সেই মেথডে শুধু ‘কী করতে হবে এবং কী করা উচিত’ এই মন্ত্রটুকুই লেখা আছে। সুতরাং এই পেশাজীবীদের অভিযোগ, গালমন্দ শোনার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হবে রণক্ষেত্রের যোদ্ধা- চিকিৎসক, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গণমাধ্যম কর্মীদেরকে। সমস্যা নেই, যুদ্ধজয়ের পর একটু বিনোদন নেয়ার জন্য রণযোদ্ধারা মানসিকভাবে তৈরি থাকবেন নিশ্চয়ই।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন