সরকার থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ ২০২০ সালের ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে কতো কিছুই না পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বছরটা শুরু হতে না হতেই অজানা এক ক্ষুদ্র দানব সবকিছু ওলট পালট করে দিয়েছে। থমকে গেছে জীবন। শুধু সময় চলে যাচ্ছে সময়ের নিয়মে। বন্দী হয়ে আছি ঘরে।
অনলাইনের খবরের কাগজ আর মাঝে মাঝে টিভির রিমোটের বাটন টেপা ছাড়া মনে হয় আর কোনো কাজ নেই। জনবহুল ঢাকা শহরের অলিগলি দিনের বেলায় কিছুটা রমরমা থাকলেও সন্ধ্যার পরে নেমে আসে সুনসান নীরবতা।
বাসা থেকে রাস্তা দেখা যাওয়ায় মাঝ রাত অবধি চলে গাড়ির প্যানপ্যানানি শব্দ। এখন গাড়ির শব্দ নেই। বারান্দায় দাঁড়ালে হিমেল শান্ত হাওয়ায় ভিজে যায় মন। দক্ষিণা বাতাসের মধুর সুর কানে বাজে। প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল হয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকালে শুভ্রনীলের গন্ধ আসে নাকে, খোলা হাওয়ায় চাঁদের খেলা।
কল্পনায় রাঙানো শহরে যখন হঠাৎ সজোরে ধাক্কা দেয় করোনাভাইরাস তখন মনে হয় কল্পনাতেই ভালো ছিলাম। বছরের শুরুতে জীবনটা অন্যরকম ছিল, অন্যরকম ছিল এই পৃথিবী। শুধু অদৃশ্য এক ক্ষুদ্র ভাইরাস থামিয়ে দিয়েছে সব কিছু, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ঘটাচ্ছে বিঘ্নতা। কেড়ে নিচ্ছে জীবন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। নেই কারও বাহাদুরি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে করেছে সমান। কোনো পরাশক্তির সঙ্গে নেই অন্য পরাশক্তির দ্বন্দ্ব।
এই ভয়ংকর সময়ে একটাই স্বস্তি যে, সারা পৃথিবীর শত্রু এখন একটাই কোভিড-১৯। এখন সবাই ব্যস্ত এই এক শত্রুর মোকাবিলা করতে। অন্য কারও পেছনে লাগার এখন আর কারও সময় নাই। এ মুহূর্তে অহংকার হয়েছে পরাভূত। অনেকের কাছেই এখন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ গুরুত্ব পেয়েছে ঢের। বেঁচে থাকার তাগিদে যতটুকু প্রয়োজন তাই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়।
কোনো রকম এ সময়টা অতিক্রম করতে পারলেই চলে। আর সে কারণেই বিকশিত হয়েছে মানবিকতা। এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেকটাই মানবিক। শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া।
মনে রাখতে হবে আমরা মানুষ কিন্তু প্রকৃতির বাইরে নয়। প্রকৃতি মানে শুধুই বৃক্ষ বা অরণ্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে জয়ী হলেও প্রকৃতি যখন ভারসাম্যহীন হয়ে যায় তখন নেমে আসে বিভিন্ন বিপর্যয়। প্রকৃতি আজ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত-মানুষ কর্তৃক কঠিন বঞ্চনার স্বীকার। প্রকৃতি তাই অনেক দিনের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিচ্ছে হয়তো।
সারা দুনিয়া জুড়ে লকডাউনের পরিস্থিতিতে পরিবেশ ফিরে এসেছে কয়েকশত বছর আগের চেহারায়। সমুদ্র সৈকতে জলকেলি করছে ডলফিন। পেঙ্গুইনরা ভদ্র পোশাকে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেড়ে গেছে পাখিদের কলরব। রাস্তায় দেখা যাচ্ছে ময়ূর। অঘোষিত লকডাউনে বাসায় বসে বিভিন্ন পত্রিকায় এ খবরগুলো দেখে বেশ ভালোই লাগে। করোনার কি তাহলে আমাদের অনেক কিছু শুধরে দিচ্ছে? সঙ্গনিরোধ দূর করেছে যান্ত্রিকতা। সুযোগ করে দিয়েছে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে, নিজের পরিবারের মধ্যে বেড়েছে সৌহার্দ্য আর সাম্য।
কোনো বিপর্যয়ই স্থায়ী নয়। পৃথিবী যতদিন থাকবে মানুষের মাঝে বিপর্যয় আসবেই, যাতে মানুষ তার কৃত কর্মের জন্য অনুশোচনা করতে পারে। মহান সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিকে শোধরানোর সুযোগ দেন মাত্র। করোনায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস ছোট হয়ে এলেও সৃষ্টিকর্তা হয়তো তৈরি করতে পারে এক নতুন পৃথিবী। হয়তো ২০২০ সালেই উঠবে এক নতুন সূর্য, আসবে ইতিবাচক কিছু। এই নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর হোক মানবিকতা। বেঁচে উঠুক এই পৃথিবী নতুন করে।
মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী