ছাড় নয় লকডাউনে, সঙ্গরোধেও চাই কড়াকড়ি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-24 03:08:23

ঢিলেঢালা হরতালের কথা মনে আছে? হরতালও হচ্ছে আবার সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। এমন শিথিল পরিস্থিতিতে মিডিয়ায় ঢিলেঢালা শব্দটির বহুল ব্যবহার ছিল।

এখন অবশ্য হরতালের দিন বা প্রায়োগিকতা অনেক কমে গেছে। কিন্তু ঢিলেঢালা শব্দটি আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জুতসইভাবে মিশে আছে।

কাজেকর্মে, দায়িত্ব পালনে, সততায়, শুদ্ধাচারে ঢিলেঢালাভাব দেখাতে পারে না এমন লোক দেশে বিরল। সারা বিশ্ব যখন রকেট বা বুলেট ট্রেনের সুপারসনিক গতিতে চলে, আমরা তখন থাকি ঢিলেঢালা। গা এলিয়ে হেলেদুলে চলি।

শুধু একটি কাজে আমাদের করিৎকর্মা মনোভাবের তুলনা হয় না। নিজের আখের গোছানোর কাজটি আমরা অতি ক্ষিপ্রতায়, অতি দ্রুততায় করতে পারি। সেটা রিলিফের চাল চুরি, টিন আত্মসাৎ, তহবিলের টাকা পকেটস্থ করা, প্রজেক্টের ফান্ড মেরে দেওয়া ইত্যাদি যাই হোক না কেন, নীতি, নৈতিকতা, ধর্ম, দর্শন জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে করতে পারি।

আরেকটি কাজও আমরা খুব করতে পারি। অপরের ক্ষতি করা, কুৎসা রটানো, পেছনে লাগা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যম ও উৎসাহের কমতি হয় না কখনোই। নিজের কাজটি রেখে পরের অনিষ্টের কাজটি করতে আমাদের আন্তরিকতা, উৎসাহ, দক্ষতা ও গতিশীলতার অন্ত নেই।

কিন্তু নিজের অর্পিত কাজের বেলায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। সেটা সরকারি বা দাপ্তরিক কাজ হোক, কিংবা ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ হোক, আমরা ঢিলেঢালা ও শিথিল। পুরনো উদাহরণ দেওয়ার দরকার নেই, চলমান করোনাভাইরাসের মারাত্মক পরিস্থিতি থেকে অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।

করোনার বিরুদ্ধে এই যে বিশ্বব্যাপী সর্বাত্মক সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধ পালিত হচ্ছে তা বাংলাদেশে ঢিলেঢালা ও শিথিল অবস্থায় চলছে। কারণ লকডাউনের মধ্যেই বিয়ে, ওরস, পীরের দরবারে হাজির হওয়া, নেতার সাথে সেলফি, ত্রাণের ফটোসেশন ইত্যাদির খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

প্রতিদিন বাসার বারান্দা থেকে দেখছি লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার পাশের মুদি দোকান বা চায়ের দোকানে স্বাভাবিক সময়ের মতো জটলা। ছেলেছোকরা ও ভাসমান লোকজন সেখানে ভিড় করে আছে।

প্রতিদিনই বিকেল ও সন্ধ্যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাইকিং করতে শোনা যাচ্ছে। সবাইকে ঘরে থাকার জন্য বলতে হচ্ছে। মাইকিং করে চলে যাবার পর পরিস্থিতি হচ্ছে পূর্ববৎ।

আমার চাক্ষুষ উদাহরণ চট্টগ্রামের একটি আবাসিক এলাকার। কিন্তু যদি জনবহুল ও ব্যস্ত এলাকার তথ্য নেওয়া হয় তো আরও ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে। নারায়ণগঞ্জ, সাভার ইত্যাদি এলাকা করোনা বিস্তারের হটস্পটে পরিণত হয়েছে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধ শিথিল ও ঢিলেঢালাভাবে পালন করার জন্য।

শহর, নগরের ব্যস্ততম জায়গাগুলোর মতোই গ্রামের পরিস্থিতি আরও ঢিলেঢালা ও শিথিল। সেখানে অনেকেই লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধ সম্পর্কে গভীরভাবে জানেই না। নিস্তরঙ্গ ও স্থবির গ্রামীণ জীবনে নিজেদের মধ্যে আড্ডা, আলোচনা একটি প্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। ঢাকা বা বিদেশ থেকে আগতরা গাল ভরে সারা গ্রামে গল্প করে বেড়াতে অভ্যস্ত। মানুষও সেসব কথা প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে শুনতে আগ্রহী এবং বাড়িতে থাকতেই বরং অনাগ্রহী।

বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই নিজের কাজ ফেলে অন্যের কথা শোনা ও আলোচনা করার মজ্জাগত প্রবণতা রয়েছে। দশজনের বিষয়ে পাঁচ কথা শোনা আর দশ কথা বলা না হলে মানুষ যে সমাজের একজন বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক জীব সেটাই যেন প্রমাণ হয় না!

এখানে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত আচরণের মানদণ্ডটিই অনেকাংশে শিথিল ও ঢিলেঢালা। কেউ যদি স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং অন্যের ব্যাপারে নাক না গলান বা কথা না বলেন এটাকে কাম্য তো মনে করা হয়ই না বরং তাকে দাম্ভিক ও অসামাজিক বলে দোষারোপ করা হয়। এদেশে নিজেকে নিয়ে থাকাকে ব্যক্তিত্ব বলে না, দশজনের সাথে অহেতুক মাখামাখি ও লম্ফঝম্প করাকেই ব্যক্তিত্ব বলে, যা ভুল।

এর ফলে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। 'এর' বাড়ি ও ঘরের কথা 'ওর' মুখ হয়ে সমাজে ছড়ায়। মানুষ এসব নিয়ে কথা বলতে ও চর্চা করতে আনন্দিত হয়! মানুষ চায়, তার কথা ভালো হোক মন্দ হোক, সবাই শুনবে এবং সবাই সব ধরনের কথা তাকে বলুক।

এমন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন ও সঙ্গরোধ অভাবনীয় বিষয়। তদুপরি সিংহভাগ মানুষ এসবের তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন। ফলে বাস্তবে ঢিলেঢালা লকডাউন, শিথিল সঙ্গরোধ চলছে এবং এভাবেই করোনাভাইরাস কমিউনিটি লেভেলে ছড়িয়ে পড়ছে।

তার সঙ্গে জরুরি জীবিকার প্রয়োজনে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের ঘরের বাইরে আসার বিষয়টিও আছে। খাদ্য ও রোজগারের জন্য তাদেরকে লকডাউন ও সঙ্গরোধ ভাঙতে হচ্ছে। এমনকি কম দামের সরকারি খাবার সংগ্রহের ক্ষেত্রেও শত শত মানুষের হুড়োহুড়ি আর মাখামাখি হচ্ছে যা করোনা বিস্তারের জন্য খুবই উপযুক্ত বিষয়।

ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের মানুষের সামাজিক সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যেও পরিবর্তন আনতে হবে। নচেৎ পুরো প্রতিরোধী কার্যক্রমই ভণ্ডুল কিংবা কম ফলদায়ক হবে এবং ঢিলেঢালা লকডাউন, শিথিল সঙ্গরোধ চলতেই থাকবে আর বাড়তেই থাকবে করোনার বিপদ।

বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, কাল-পরশুই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে লকডাউন ও সঙ্গরোধের পর্ব শেষ হবে এমন নয়। এমন পরিস্থিতি আরও অনেক দিন চলতে পারে এবং করোনার বিপদ কেটে গেলেও আমাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষা ও সামাজিক মেলামেশায় অনেক কিছুই বদলানোর দরকার পড়বে। সঙ্কট ও বিপদ থেকে আহরিত শিক্ষা নিয়ে সেই পরিবর্তনকে অনুধাবন করাও জরুরি।

বাড়ি যে শুধু খাওয়ার জন্য আর রাতে ঘুমানোর জন্য হোটেলের মতো আবাস নয়, বসবাস ও জীবনধারণের স্থল সেটাও বুঝতে হবে। বাড়িতে ঘুমানোর জায়গার পাশাপাশি বসার ও পড়ার একটি ব্যবস্থাও থাকতে হবে এবং নিদেনপক্ষে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি ও স্টাডিরুম থাকাও অপরিহার্য।

দুঃখের বিষয়, বহু তথাকথিত বড়লোক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বাড়িঘরে এমন ব্যবস্থা নেই। গরিব ও নিম্নবিত্তের মানুষের ঘরে তো অকল্পনীয়। যা আছে তা হলো একটি টেলিভিশন আর মোবাইল। সারাদিন তাতে চোখ রেখে স্নায়ুবৈকল্য হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে বাইরে মন চলে যাওয়াও স্বাভাবিক।

ঢিলেঢালা হরতালের মত ঢিলেঢালা লকডাউন নামক লুকোচুরি ও শিথিলতার খেলা বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে করোনা মহামারির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া যেমন অপরিহার্য, তেমনি এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ও প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম ও প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর