দশ টাকা অভিহিত মূল্যে ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ফ্যামিলি টেক্সটাইল লিমিটেড। তালিকাভুক্তির প্রথমদিন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয় ৪৮ দশমিক ৫০ টাকা। সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে সোমবার (১৪ অক্টোবর) লেনদেন হয়েছে ২ দশমিক ৭০ টাকায়। অর্থাৎ কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি নেই ৪৬ টাকা।
একই খাতের কোম্পানি কাট্টালি টেক্সটাইল লিমিটেড। ২০১৮ সালে প্রথমদিন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছিল ২৪ দশমিক ৪০টাকা। সোমবার সেখান থেকে কমে লেনদেন হয়েছে ১২ দশমিক ৯০ টাকা। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ১২ টাকা পুঁজি নেই। ফেইক প্রতিবেদন নিয়ে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ফেসভ্যালুর কাছাকাছি চলে এসেছে।
শুধু তাই নয়, আইপিওর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে চলতি বছর তালিকাভুক্ত হওয়া রানার অটোমোবাইলের শেয়ার লেনদেন হয়েছিল ৯৯ দশমিক ৮০ টাকায়। কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ দিন লেনদেন হয়েছে ৬৪ দশমিক ৭০ টাকায়। অর্থাৎ এই কোম্পানির শেয়ার থেকেও বিনিয়োগকারীদের ৩৪ টাকার বেশি পুঁজি চলে গেছে।
ঠিক একইভাবে ভালো কোম্পানি বলে পরিচিত গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মাসহ প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে।আর এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রতিনিয়তই পুঁজি হারিয়ে নিস্তেজ হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পর থেকে চলা মহাধসে বিনিয়োগকারীদের ৬৪ হাজার ১৯৭ কোটি ৭৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকার পুঁজি নেই হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের(ডিএসই)। ব্রোকারেজ হাউজগুলো নিজের পুঁজি রক্ষায় ফোর্স সেল করছে। লোসকান কমাতে গিয়ে হাজার হাজার লোক ছাঁটাই করছে। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর শাখাও বন্ধ করে দিচ্ছে।
ডিএসই ও সিএসইর সদস্য, একটি ব্রোকারেজের এমডি বলেন, '৩ কোটি টাকার শেয়ার এখন ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। রোববারও ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। একদিনের ব্যবধানে কমেছে ৩ লাখ টাকা। তিনি বলেন, এটাতো আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের অবস্থা। ডিলার অ্যাকাউন্টের অবস্থা আরও খারাপ।'
একইভাবে আর্তনাদের কণ্ঠে লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী ইয়াকু আলী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, 'সাত মাসে আমার দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে পুঁজি নেই ৩ কোটি টাকা। এখন যে টাকা রয়েছে সেগুলো বিক্রি করতে পারছি না। বিক্রির অর্ডার দিলে শেয়ার বিক্রি হয় না।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর একজন সদস্য বলেন, 'পুঁজিবাজার নামক বাসটি ব্রেক ফেল করেছে। একটি দ্রুতগতির বাস ব্রেক ফেল করলে তাতে বসে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া যেমন কিছু করা যায় না। ঠিক সেইভাবে পুঁজিবাজার পুঁজি হরণ করে নিচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করতে পারছি না।'
তিনি বলেন, 'সন্তান হারালে কিছু দিন পর ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু টাকার শোক ভোলা যায় না।'
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার এখন আর পুঁজিবাজার নেই। ভূয়া কোম্পানিগুলোকে আইপিওর মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের জন্য অনুমোদন দিয়ে অনেকটা গরু মোটাতাজাকরণ বাজারে পরিণত করা হয়েছে। গরুকে আকর্ষণীয় করতে ঈদের আগে যেমন করে ইনজেকশন দিয়ে ফুলানো হয়। এরপর ডেট ওভার হওয়ার পর গরুগুলো বিক্রি না হলে শুকিয়ে যায় কিংবা মারা যায়।
ঠিক সেইভাবে ২০১০ সালের ধসের পর থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন(বিএসইসি) গত সাত বছরে ভুয়া কোম্পানিগুলোর আইপিওর অনুমোদন দিয়ে বাজারটাকে মোটাতাজাকরণ বাজারে পরিণত করেছে। ফলে দিন যাচ্ছে আর বাজারে পচন ধরেছে। লেনদেনের প্রথমদিন ৫০টাকা বিক্রি হওয়া শেয়ার এখন ২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর তাতে বাজারে আস্থার সংকট চরম আকারে ধারণ করেছে।
ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, পুঁজিবাজারে ফি ফল হচ্ছে। বিনিয়োগকৃত শেয়ারের দাম প্রতিদিনিই কমছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী সবাই একটু শেয়ারের দাম বাড়লেই বিক্রি করে দিচ্ছে। ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অধ্যাপক আবু আহমদ বলেন, পুঁজিবাজার এখন চিটিংয়ের বাজার। এখানে চাহিদার তুলনায় এখন মন্দ শেয়ারের পরিমাণ অনেক বেশি। এই মুহূর্তে বাজারে যেখানে বিশেষ সার্পোট দিয়ে শেয়ার কেনার কথা, সেখানে নতুন কমিশন উল্টো আরও আইপিও ও রাইট শেয়ারের অনুমোদন দিচ্ছে। অর্থাৎ সেকেন্ডারি মারর্কেটে শেয়ার ঢেলে দিচ্ছে। আর তাতে শেয়ারের দাম কমছে।
তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, পুঁজিবাজারে সুশাসনের অভাব। তাই এখানে আশা ভরসার কিছু নেই। বাজারে স্বার্থে প্রয়োজন সরকারের বিশেষ উদ্যোগ।