নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেন না।বছরের বেশির ভাগ সময় থাকেন ছুটিতে, বেতনও নেন দ্বিগুণ।তার নাম এ কে এম জিয়াউল হাসান খান। তিনি দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান রেগুলেটরি কর্মকর্তা (সিআরও)।
ডিএসইর ব্যবস্থাপনা বিভাগ কিংবা ডিএসইর পর্ষদের কেউ তাকে কিছু বলতেও পারছেন না। কিছু বললেই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে চাপ দেওয়া হয়। দেখে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। এই সুযোগে তিনি একের পর এক দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন।
ডিএসইর তথ্য মতে, সিআরও সর্বশেষ ৯ ও ১২ ডিসেম্বর অসুস্থতা দেখিয়ে ডিএসই থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়েছেন। এরপর গত ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত যোগদান করেননি। তিনি কারও সঙ্গেও যোগাযোগ করেননি। কিন্তু তারপরও স্বপদে বহাল রয়েছেন জিয়াউল হাসান। কিন্তু ডিএসই কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি।
আরও মজার তথ্য হলো-২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট পৌনে চার বছরের মধ্যে ৩৬৪ দিন অর্থাৎ এক বছর ছুটিতেই ছিলেন। যা সাপ্তাহিক ও সরকারি ও বিশেষ ছুটি মিলে ২ বছরের বেশি সময়।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসইর পরিচালক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘ডিএসইর এই কর্মকর্তা যতই অনিয়ম করুক, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এমনকি তার অপরাধের বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করা যায় না। হলেই উপর মহল থেকে চাপ আসে।’
জানা গেছে, উপর মহল হলো বিএসইসি। জিয়াউল হাসান বিএসইসির একজন নির্বাহী পরিচালকের বন্ধু। তার এই শক্তি জুড়েই ডিএসইর পর্ষদ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। তার মাধ্যমে কমিশনের কর্তারা ডিএসইর সব ধরনের গোপন তথ্য নেয়।
এ বিষয়ে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত এমডি আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর সঙ্গে রোববার (৫জানুয়ারি) যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সিআরও’র সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করতে চাইলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে ডিএসইর সাবেক এক পরিচালক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসিআই লিমিটেড ও রহিমা ফুডের সংবেদনশীল তথ্য গোপন করেছেন সিআরও। তাতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। এই সব ইস্যুতে একাধিকবার ডিএসইর পর্ষদ তাকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু ডিএসইর এমডি সিআরওকে দর্শানোর নোটিশ দিতে পারেনি।’
অথচ তাকে বাঁচাতে নির্দোষ ডিএসইর মার্কেট অপারেশনস ডিপার্টমেন্টের প্রধান সায়িদ মাহমুদ জুবায়েরকে বরখাস্ত করা হয়। সে সময় ওয়েবসাইটে এসিআই লিমিটেডের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশ করা হয়। কোম্পানিটি আলোচ্য প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ৯৯ পয়সা লোকসান করেছে। অথচ আলোচ্য প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ১৯ পয়সা মুনাফা হয়েছে বলে ডিএসইতে সংবাদ প্রকাশ করে। এ কারণে ডিএসইর পর্ষদ সিআরওকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ডিএসইর এমডি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সামিট পাওয়ারের সঙ্গে একই গ্রুপের তিন কোম্পানি সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার, সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার এবং সামিট উত্তরাঞ্চল পাওয়ার একীভূতকরণ কার্যক্রম আদালতের নির্দেশনা মেনে হয়েছে কি-না, তা যাচাই না করেই কোম্পানিগুলো একীভূত হয়। এছাড়া সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ারকে তালিকাচ্যুত করার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বুঝিয়ে না দেয়া এবং একইসঙ্গে সামিট পাওয়ারের শেয়ার লেনদেন চালু রাখার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ডিএসই থেকে যে অনিয়ম করা হয় তার পেছনের মূল কলকাঠি নাড়েন সিআরও’র দায়িত্ব পালন করা জিয়াউল হাসান খান।
যে কারণে জিয়াউল হাসান খানসহ তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তের জন্য সেই বছরের আগস্টে বিএসইসির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন নিজামী ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমানকে ডেকে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে সব দায় উপ-মহাব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। আর জিয়াউল হাসান খানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। এতে একপর্যায়ে নিজাম উদ্দিন ডিএসইর চাকরি ছেড়ে দেন।
এছাড়া রহিমা ফুড কর্পোরেশন লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারের মালিকানা হস্তান্তরের মতো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ নিয়েও গত বছর সিআরও’র বিরুদ্ধে লুকোচুরির অভিযোগ ওঠে। রহিমা ফুডের পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যেকে সিটি সুগার মিল ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে তাদের শেয়ার স্থানান্তরের ঘোষণা দেয় এবং সেই তথ্য ডিএসইকে জানায়। কিন্তু ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে সেই তথ্য প্রকাশ করা হয় দেরি করে। মালিকানা পরিবর্তনের মতো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দেরি করে প্রকাশ করায় ডিএসইর সিআরও’র বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ওঠে।