ঋণের নামে ২৩৮ কোটি টাকা লুটসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের(দুদক) তালিকায় থাকা সেই কাজী ছানাউল হকই হচ্ছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি)।
তিনি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)’র সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানির মার্জিন একাউন্টের বিপরীতে ঋণের নামে ২৩৮ কোটি টাকা লোপাট করেন।
সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে তাকে নিয়োগ দিতে এরই মধ্যে সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছে ডিএসইর এনআরসি কমিটি। তার সঙ্গে আরেক জনের নাম ডিএসইর পর্ষদে পাঠাবে। সেখান থেকে প্রস্তাব পাশ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে(বিএসইসি) চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। তার জন্য স্বয়ং ডিএসইর এনআরসি কমিটিতে থাকা একজন পরিচালক তদবির চালাচ্ছেন।
শুধু তাই নয় ছানাউল হক বিএসইসিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে ডিএসইর পর্ষদকে চাপও দিচ্ছে বলে জানিয়েছে ডিএসই’র এক পরিচালক। তিনি বলেন, এই জন্য ক্লিন ইমেজের পাশাপাশি এমডি হিসেবে কাজের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সাবেক এমডি কে এ এম মাজেদুর রহমানকে পুনঃনিয়োগের জন্য ডিএসইর সুপারিশ অনুমোদন করেনি বিএসইসি। এর ফলে প্রায় ছয়মাস ধরে এমডিহীন ছিল ডিএসই।
ফলে অভিভাবক শূন্য পুঁজিবাজারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৮৫ হাজার কোটি টাকা। ব্রোকারেজ হাউজগুলো দেউলিয়ার পথে।
ডিএসইর সাবেক এক পরিচালক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আইসিবির সাবেক এমডি দায়িত্ব পেলে, পুঁজিবাজার আর পুঁজিবাজার থাকবে না। আস্তে আস্তে বিনিয়োগকারী শূন্য হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক মানও হারাবে। দেশ ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে উচিৎ একজন ভালো ও ডাইনামিক ব্যক্তিকে ডিএসইর এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মঙ্গলবার ডিএসইর এমডি নিয়োগে মোট ৬ প্রার্থীর সাক্ষাৎকারে মোট ৪জন অংশগ্রহণ করেছেন। এরা হলেন-আইসিবির সাবেক এমডি কাজী ছানাউল হক, যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি শফিকুল আলম, জনতা ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শরীয়ত উল্লাহ এবং গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের সাবেক সচিব ও সিএফও সারোয়ার খান।
কাজী ছানাউল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি ডিএসই’র এমডি হতে চাই বলেই সাক্ষাৎকার দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেবে ডিএসই। আমি ডিএসইর এমডি হলে পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করবো।
ডিএসইর তথ্য মতে, দুই দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যোগ্য এমডি না পাওয়ায় ডিএসই সময় নিয়ে গত ১০ ডিসেম্বর তৃতীয় দফায় এমডির খোঁজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে আগ্রহী প্রার্থীদেরকে আগামী ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে জীবনবৃত্তান্তসহ আবেদন পাঠাতে বলা হয়। এতে ২৪ জন আবেদন করেন। এরমধ্য থেকে ৬ জনকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়।
চলতি বছরের ১১ জুলাই ডিএসইর এমডি পদ শূন্য হয়। ওই পদ পূরণে নতুন এমডির খোঁজে গত ৭ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এতে আগ্রহী প্রার্থীদেরকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। যেখানে ১৬ জন আবেদন করেছিলেন। তবে ওই ১৬ জনের মধ্যে কাউকেই যোগ্য মনে করেনি ডিএসইর পর্ষদ এবং নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি (এনআরসি)।
এরপরে গত ৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় এমডির খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই। এক্ষেত্রে আবেদন করেছিল ৩ জন। অর্থাৎ দুই দফায় ১৯ জন ডিএসইর এমডি পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিল।
দুই দফায় আবেদনকারীদের মধ্য থেকে গত ২ অক্টোবর ৭ জন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। পরবর্তীতে ৭ জনের মধ্যে ৩ জনকে নিয়ে শর্ট লিস্ট করা হয়। যাদেরকে গত ৬ অক্টোবর ডিএসইর পর্ষদ ডাকে। তবে ওই ৩ জনের মধ্যেও কাউকে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য যোগ্য মনে করেনি পর্ষদ। যাতে যোগ্য এমডির খোঁজে আবারও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৬ অক্টোবরের পর্ষদ সভায়। যা গত ১০ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়।
উল্লেখ্য, ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথকীকরণে ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমের পর দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৬ সালের ২৯ জুন নিয়োগ পান কে এ এম মাজেদুর রহমান। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১১ জুলাই। তারপর থেকেই ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আবদুল মতিন পাটোয়ারী ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ছানাউল হকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আইসিবির এমডি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় কাজী ছানাউল হক আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানির সিইও। দায়িত্ব পালনের সময় ৫১৪ মার্জিন একাউন্ট থেকে বিভিন্নভাবে ২৩৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডে (আইএসটিসিএল) ২৩৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকার লুটে জড়িত হিসেবে তৎকালীন সিইও কাজী ছানাউল হক, উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ফারাজীসহ ছয়জনকে চিহ্নিত করা হয়।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএসটিসিএল এর প্রধান কার্যালয়ের ১৯১টি পিটি হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৩৭ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার টাকার মার্জিন ঋণ দেওয়া হয়। মূলত ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের প্রথম দিকেই মার্জিন ঋণ সীমার ব্যাপক অনিয়ম ঘটিয়ে সিকিউরিটিজ কেনা হয়। ১০৩২ নম্বর পিটি হিসাবে ডেবিট স্থিতি থাকা অবস্থায় কাজী ছানাউল হকের মেয়াদকালে ২০০৮ সালের ১৯ অক্টোবরে ১৭ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯১ টাকার ক্রেডিট স্থিতির ওপর ১৮ লাখ টাকা এবং ২০ অক্টোবর ৫১ হাজার টাকা ডেবিট স্থিতির ওপর পুনরায় ৭ লাখ টাকা তহবিল উত্তোলন দেওয়া হয়েছে। যা বিধিবহির্ভূত এবং গুরুতর অনিয়ম।
৪৪৮১ নম্বর পিটি হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা ডেবিট স্থিতি থাকা অবস্থায় ছানাউল এবং উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ফারাজীর মেয়াদে ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর সিকিউরিটিজ অন্য প্রতিষ্ঠানের লিংক বিওতে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা শতভাগ নিয়ম লঙ্ঘন। এমন ঘটনায় আইসিবি ব্যাংক তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি অর্থ লুটপাটের সত্যতা পায়। তদন্ত কমিটি তদন্তে পাওয়া অনিয়ম ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন আইসিবিতে জমা দেয়। পরে তা অর্থ মন্ত্রণালয়েও জমা দেওয়া হয়।