অভিনয়ের সবচেয়ে আদি ও নিপুণতম মাধ্যম ‘মঞ্চ’। এদেশের মঞ্চ অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করা কঠিন। তবে পুরো একটি নাটক একা অভিনয় করেছেন এমন শিল্পীর সংখ্যা হাতে গোনা। মজার বিষয় হলো, শোবিজ অনেকটাই পুরুষশাসিত হলেও মঞ্চে একক নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে। এবার সেই সম্মানজনক তালিকায় যোগ হচ্ছেন মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেত্রী সুষমা সরকার। দেশ নাটকের একক নাটক ‘পারো’তে প্রথমবার অভিনয় করবেন আগামী ২৯ তারিখ। এই নাটক ও সমসাময়িক বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন বার্তা২৪.কমের সঙ্গে। কথা বলেছেন মাসিদ রণ
প্রথমবার একক নাটকে অভিনয় করতে যাচ্ছেন, অনুভূতি কেমন?
থিয়েটারের প্রায় সব অভিনয়শিল্পীর জীবনে যে কটা গোল থাকে তার একটি হলো একদিন তিনি একক নাটকে অভিনয় করবেন। একাই একটি গল্পের সবগুলো চরিত্র ফুটিয়ে তুলবেন। একাই পুরো মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াবেন তার এতোদিনের অভিজ্ঞতা, ডেডিকশন আর চর্চার ওপরে সাওয়ার করে। কিন্তু গুটিকয়েক শিল্পী এই সুযোগ পান। আমাদের ‘দেশ নাটক’ থেকে প্রথম একক নাটক হয়েছে ‘পারো’। নাটকটি মূলত নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম রেজা রচনা করেছেন বন্যা মির্জার কথা ভেবেই। তিনিই নাটকটির প্রথম দুটি শো করেছেন। এবার সেই নাটকে আমি অভিনয় করতে যাচ্ছি। আসছে ১ জুলাই আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। নতুন প্রযোজনা হিসেবে এটিকেই দল থেকে মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ২৯ জুন থেকে টানা ২ জুলাই পর্যন্ত পরপর চারটি শো করবো শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। একক নাটক করতে যাচ্ছি একটা একদিক থেকে যেমন অনেক বেশি আনন্দ ও সম্মানের, অন্যদিকে খুব নার্ভাস লাগছে। শোয়ের দিন কেমন পারফর্ম করবো? দর্শক কতোটা উপভোগ করবে- এসব নিয়ে এক ধরনের চাপ থেকেই যায়।
‘পারো’ একজন মধ্যবিত্ত পেশাজীবী নারীর গল্প। হাফ ডজনের বেশি চরিত্র রয়েছে নাটকটিতে। পুরো নাটকটি আত্মস্থ কবে থেকে রিহার্সেল করছেন?
অনেকদিন ধরেই একটু একটু করে রিহার্সেল করছিলাম। তবে পুরোদমে শুরু করি ঈদের আগে থেকে। ইচ্ছে ছিল অন্তত এক মাস টানা রিহার্সেল করার। কিন্তু ঈদের সময় তো টিভির কিছু কাজ করতেই হয়। তাই ঈদের পর থেকে টানা রিহার্সেল করছি। এরমধ্যে আর কোন শুটিং রাখিনি। শুধুমাত্র ‘পারো’ নিয়েই আছি। দেখা যাক প্রথম শো কেমন হয়, তাহলে অনেকটাই বুঝতে পারবো আর কোন কোন জায়গায় নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
‘পারো’র গল্পে যে কনফ্লিক্টগুলো, সেগুলো সমাজের দৃষ্টিতে ছোট ছোট সমস্যা। অনেকে মনে করতে পারেন এ নিয়ে পারো কেন এতো বেশি রি-অ্যাক্ট করছে?
হ্যাঁ, এটা একদমই ঠিক বলেছেন। পারো খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি মেয়ে। তার মানে এই নয় যে, সে অনেক বেশি অধিকার চায়, জীবনটাকে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে সাজাতে চায়। সে আসলে একজন মানুষের যতোটুকু পাওনা সমাজের কাছে ঠিক অতোটুকু নিয়েই বাঁচতে চায়। কিন্তু সেটাও কি আমাদের সমাজ নারীদেরকে দেয়? আমি হলফ করে বলতে পারি, রাজধানীর বাসে চড়া প্রতিটি নারী আনকম্ফোর্টেবল সিচুয়েশনে পড়েন কোন না কোন সময়। অনেক নারীই স্বামীর দ্বারা, বসের দ্বারা, বাড়িওয়ালার দ্বারা আলাদা আলাদাভাবে নির্যাতিত হন। শারীরিক, মানসিক- এই নির্যাতন প্রতিদিন নারীর ভেতরের ‘আমি’কে ক্ষত বিক্ষত করে। সুতরাং ২০২৪-এ এসে আমরা শুধু বড় ইস্যু হিসেবে যেগুলো গণ্য সেগুলো নিয়ে কথা বলব, তা কিন্তু নয়। সময় এসেছে নারীর ছোট বড় সব ইস্যু নিয়ে কথা বলার। কারণ সমাজে টক্সিক রিলেশনশীপ এতোটাই প্রকট হচ্ছে যে এ নিয়ে এখন কথা না বললে বড্ড দেরী হয়ে যাবে।
‘পারো’ নাটকের কোন দিকটি আপনাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করছে?
পুরো নাটকটাই মাসুম রেজা অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা, যুক্তি এবং সমসাময়িক জায়গা থেকে লিখেছেন। তাই সবটাই আমার খুব ভালো লেগেছে। এই সময়ের নারীদের কণ্ঠ হয়ে আমি কথা বলতে পারছি দর্শকের সামনে, এটাই বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছে ‘পারো’র শরীরি স্বত্তা ও অন্তর স্বত্তার কথোপকথনের জায়গাগুলো। আরেকটি বিষয়, তুমি গোপনে সব করতে পারবে, সবাই সবটা মেনে নেবে। তবে তুমি কিছু নিয়ে সরব হলেই জাত গেলো, কেউ তোমাকে পাতে তুলবে না! এই হিপোক্রেসি তো সমাজে রয়েছে, সেটা নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে ‘পারো’তে। এটাও আমাকে স্পর্শ করেছে। সব নারী এই নাটকের সঙ্গে একাত্ত হতে পারবেন। কারণ তাদের জীবনে এই ইনসিডেন্টগুলো কোন না কোন সময় ঘটেছে।
এর আগে বন্যা মির্জা ‘পারো’ নাটকটি করেছেন। এবার আপনি করছেন। এমন পরিস্থিতিতে তুলনা চলেই আসে। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন? তার থেকে নিজের পারফরমেন্স আলাদা করার চেষ্টা করছেন কি না?
দর্শক তুলনা করতে পারেন, তাদের সেই স্বাধীনতা রয়েছে। তবে আমি পারফর্মার হিসেবে তেমন কিছু ভেবে কিছুই করছি না। আমি শুধু আমার সর্বোচ্চ দিয়ে নাটকটি যাতে ভালো হয় সেই চেষ্টা করছি। তাছাড়া যতোই একই চরিত্র করা হোক না কেন, প্রতিটি র্শিল্পী কিন্তু তা আলাদাভাবেই করেন। কারণ প্রতিজনের অভিনয়ের আলাদা স্টাইল থাকে। আমি বরং এই সুযোগটিকে আর্শিবাদ হিসেবে দেখছি যে বন্যা আপা আমাকে নাটকটি করার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন।
ঢাকার মঞ্চে আপনার দেখা প্রিয় একক নাটক কোনটি?
একটি নাটকের নাম বলা যাবে না কোনভাবেই। কারণ প্রতিটি নাটক বা তার শিল্পী স্পেশ্যাল বলেই একক নাটক নিয়ে মঞ্চে নামেন। তবে আমি যেগুলো দেখেছি তারমধ্যে প্রথমেই বলবো কলকাতার শিল্পী গৌতম হালদারের ‘মেঘনাদ বদ’-এর কথা। কলকাতার শাওলি মিত্রের একটি একক নাটক দেখেছিলাম, ওটাও খুব ভালো লেগেছে। এছাড়া শিমুল ইউসুফের ‘বিনোদিনী’, মোমেনা আপার ‘লালজমিন’, রোজি সিদ্দিকীর ‘পঞ্চনারী আখ্যান’ দেখেছি। জ্যোতি সিনহার ‘কহে বীরাঙ্গনা’ তো সম্প্রতি ১০০তম মঞ্চায়ন হলো। সবগুলোই ভালো লেগেছে।