মীরা নায়ার সিনেমা যার কাছে একটি রাজনৈতিক বিষয়

, ফিচার

যাকওয়ান সাঈদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 12:54:04

মীরা নায়ারকে নানান কারণে আমরা জাকজমকভাবে চিনি না। এগুলোর মধ্যে প্রধান কারণটি হলো, তিনি ভারতীয় মূলধারার ফিল্মমেকার নন। এবং একই সঙ্গে বলিউডের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা এই ফিল্মমেকারের হাত দিয়েই তৈরি হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে আছে, ‘কামা সূত্র : আ টেল অব লাভ’, ‘সালাম বোম্বে’ এবং ‘মনসুন ওয়েডিং’।

মীরা নায়ারের জন্ম ১৯৫৭ সালে, ভারতে ওড়িশা প্রদেশে। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। এবং সেখানে তিনি স্কুল অব আর্টসের চলচ্চিত্র বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেব কর্মরত আছেন।

তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো, তিনি যোগব্যায়ামকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই চর্চার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তার ফিল্মমেকিংয়ের ক্ষেত্রেও তিনি যোগব্যায়ামের সংশ্লিষ্টতা তৈরি করেছেন। শুটিংয়ের দিনগুলোতে তিনি সকাল আরম্ভ করেন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে যোগব্যায়াম করার মধ্য দিয়ে।

◤ মিসিসিপি মাসালা সিনেমার সেটে মীরা নায়ার ◢

 

মীরা নায়ারের কাছে ফিল্মমেকিং একটি এক্টিভিটিও। ‘ইয়ুথ কি আওয়াজ’ নামক একটি ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি সিনেমা বানানো একটা পলিটিক্যাল ব্যাপার। এমন না যে এটা পলিটিক্যাল হয়ে ওঠে। বরং এর সূচনাটাই পলিটিক্যাল, অর্থাৎ আপনার সিনেমায় আপনি পৃথিবী সম্পর্কে কী বলতে যাচ্ছেন? আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? আপনি ঠিক কোন জায়গা থেকে পৃথিবীকে দেখছেন? আপনার সিনেমায় দেখাবার জন্য আপনি কোন জিনিসকে বেছে নিচ্ছেন? আমার খুব দৃঢ়ভাবে মনে হয়, যদি আমরা আমাদের গল্পগুলো না বলি, তাহলে কেউ এসে আমাদের গল্পগুলো বলে দিবে না।

◤ মীরা নায়ার পরিচালিত ‘কামা সূত্র : আ টল অব লাভ’ ◢

 

এরপরেই নায়ার আরো নির্দিষ্টভাবে বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন—‘নিউইয়র্কে, আমেরিকাতে, উগান্ডাতে, এমনকি ইন্ডিয়াতেও আমি এই স্বাভাবিক চলমান পৃথিবীটাকে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে সিনেমা বানানোর অফার পেয়েছি, কিন্তু সিনেমা বানাবার বিষয় হিসেবে আমি সেগুলোকে গ্রহণ করিনি। কেননা আরো অনেকেই ওইসব গল্পগুলো বলে দিচ্ছেন।

আমি খুব গভীরভাবে অনুভব করি, আমার সত্তা, আমার ক্যামেরা, আমার চোখ, আমার হৃদয়, এইসব কিছুই তাদের সহযোগে থাকা উচিত যারা খুব বেশিভাবে আমার, এবং বেশিরভাগ সময় যাদেরকে আমরা শুনতে বা দেখতে পাই না।

◤ মীরা নায়ার পরিচালিত ‘সালাম বোম্বে’ ◢

 

মীরা নায়ারের সিনেমা ‘কামা সূত্র : আ টেল অব লাভ’ ভারতে নিষিদ্ধি করা হয়েছিল সিনেমাটির যৌনদৃশ্যের বাহুল্যের কারণে। ‘ইয়ুথ কি আওয়াজ’ ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারগ্রাহক এই প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন, ‘বর্তমানে ভারতে যৌনতা বা প্রেম, অথবা অন্তরঙ্গতা তার সংজ্ঞাকে মেলে ধরতে পারে কিনা। এমন প্রশ্নের উত্তরে নায়ার বলেছিলেন, ‘এরকম দেখতে পাওয়া আনন্দদায়ক যে, এখন প্রেমের বহুমুখী বৈচিত্রগুলোকে গ্রহণ করা হচ্ছে এমন এক পন্থায়, যেটা অতিশয় আরোপিত বা ছিনালিপূর্ণ না। এই কাজটাই আমি কামা সূত্রে করতে চেয়েছি। আমরা এমন একটা দেশে জন্মেছি, যার প্রেম ও কামসা-বাসনা প্রসঙ্গে নিজস্ব প্রথা বা আচার-ভঙ্গিমা আছে। সংক্ষিপ্তভঙ্গিতে এই ব্যাপারটাকে যেভাবে বিবেচনা করা হয় যে, এটা মানুষের সেক্সুয়াল পজিশনগুলোর একটা পপ-আপ, আদতে এটা তা নয়। এটা এর চাইতে আরো গভীর বিষয়। এটা বিষয় হিসেবে যৌনতার এক বৃহৎ বিশ্লেষণ, এমনকি আমাদের সামাজিকতারও।

◤ মীরা নায়ার পরিচালিত ‘মিসিসিপি মাসালা’ ◢

 

‘মিরাবাই ফিল্মস’ নামে মীরা নায়ারের একটি প্রযোজনা সংস্থা আছে। ১৯৮৮ সালে তার পরিচালিত ‘সালাম বোম্বে’ সিনেমাটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন ক্যামেরা পুরস্কার পেয়েছিল। এছাড়াও তিনি নানা ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে আছে একাডেমি পুরস্কার এবং গোল্ডেন ক্লাব পুরস্কার। ২০১২ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল তাকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ প্রদান করেন। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরান্ডা হাউজে লেখাপড়া করেছেন। এবং পরবর্তীতে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেছিলেন। 

নিচে মীরা নায়ারের বেশ কিছু উক্তি উল্লেখ করা হচ্ছে, যেগুলোর মধ্য দিয়ে তাকে আমাদের আরো ভালোভাবে বোঝা সম্ভব হবে—

১. কোনো জিনিসকেই এরকমভাবে ভাববেন না, যেন আপনি পথ থেকে পাথর সরাচ্ছেন। যাই করেন, সম্পূর্ণভাবে করুন, কাজটা শেষ হওয়া পর্যন্ত সেটার সঙ্গে থাকুন।

২. যদি আমরা আমাদের গল্পগুলো না বলি, অন্য কেউ এসে বলে দেবে না।

৩. সিনেমা বানানোর ব্যাপারটা হলো, পুরদস্তুরভাবে এটার সঙ্গে মিশে যাওয়া আর একটা বিচারবুদ্ধিহীন আত্মবিশ্বাস নিজের মধ্যে বদ্ধমূল করে নেওয়া। এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বটে, এখানে আমাদের ধারণ করতে হয় কবির মতো মন, আর হাতির মতো শক্ত চামড়া।

৪. আমরা সবাই সিনেমার শক্তি সম্পর্কে জানি। আপনি যেভাবে তাকান বা যেভাবে কথা বলেন, তারই প্রতিরূপ যখন আপনি সিনেমার চরিত্রদের মধ্য দিয়ে দেখতে পান, তখন আপনার এই দেখার চাইতে শক্তিশালী কিছু আর এখানে থাকতে পারে না।

৫. রসিকতা অথবা জীবন নিয়ে দুষ্টামি করা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্যথায় জীবন খুব একঘেয়েমি হয়ে যেত।

৬. আমি আজও সেইসব লোকেদের গল্পগুলোতেই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণবোধ করি, যাদেরকে সমাজের বাইরের লোক মনে করা হয়।

৭. প্রত্যেকটা সিনেমাই একটা রাজনৈতিক আখ্যান। এই অর্থে যে, আপনি আসলে কিভাবে পৃথিবীটাকে দেখছেন।

৮. আমার কাছে, সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। কিন্তু হলিউডের চিন্তাচেতনায় এই বিষয়ের অস্তিত্ব নেই।

৯. প্রত্যেকটা ফ্রেম এবং প্রত্যেকটা দৃশ্যেরই একটা উদ্দেশ্য থাকা জরুরি।

১০. আমি যেই ফিল্মস্কুল থেকে উঠে এসেছি, সেটা একটা ডকুমেন্টারি ফিল্মের স্কুল। স্কুলেটির দর্শন এমন ছিল যে, যে বাস্তবতা ঘটে যাবার পরে সেই বাস্তবতার ওপরে তুমি নতুন কিছু আরোপ করতে পারো না, তবে এডিটিং রুমে বসে তুমি সেটার একটা আখ্যানরূপ তৈরি করতে পারো।

১১. নাইন ইলিভেনের দুর্ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করিনি। সেই অন্যায় অবিশ্বাস আর জাতিঘৃণা আজ চলমান, যেটা আমাকে ভালোভাবেই দেখতে হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর