যেই আবিষ্কারগুলো আজকের এই বাস্তবতা তৈরি করেছে

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 10:03:23

স্মার্টফোন, ট্যাবলেট কিংবা ল্যাপটপের জয়জয়কার চতুর্দিকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো একটা ছাড়া আজ আমাদের জীবন আর ভাবাই যায় না। সত্যি বলতে, পৃথিবীর ইতিহাসের এমন কিছু আবিষ্কার বদলে দিয়েছে মানবজাতির ভাগ্য। ইউভাল নোয়াহ হারারি দাবি করেছেন, মানুষ শিকার জীবনে অন্যান্য প্রাণীকে অতিক্রম করল তখনই, যখন আবিষ্কার করতে পারল আগুন। কারণ এর পর থেকে খুব সহজে সেদ্ধ করে ফেলা গেল শিকার করা প্রাণীর হাড়-মাংস। সুতরাং দাঁতে এলো পরিবর্তন। অন্যদিকে ছোট্ট এক টুকরো আগুন নিয়ে মানুষ গোটা বনকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করল। সাধারণ প্রাণী থেকে পরিণত হলো সভ্যতার অধিনায়কে। সভ্যতার প্রাচীনতম সকাল থেকে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করার জন্য এভাবে আবিষ্কার করেছে অনেক কিছুই। কিংবা আবিষ্কারের পর বদলে গেছে পৃথিবীর নিয়তি। এমন কিছু আবিষ্কার ও প্রযুক্তি নিয়েই আজকের আয়োজন।

পাথরের অস্ত্র

পাথরের অস্ত্র মানবজাতির সবচেয়ে প্রাচীন প্রযুক্তি। মানুষের পূর্বপুরুষ ‘হোমো হাবিলিস’রা প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে পাথরের অস্ত্র আবিষ্কার করে। বর্তমান চোখ দিয়ে দেখলে খুব সাদামাটা। পাথরকে ভাঙা হতো। তারপর কেটে, থেতলে যেমন খুশি আকৃতি দেওয়া হতো। কিন্তু এই সহজ বস্তুটি মানুষকে আলাদা করে ফেলেছে অন্যান্য প্রজাতি থেকে। 

মানুষ তার প্রয়োজনে কোনো কিছু ভাঙতে কিংবা কাটতে এই পাথর ব্যবহার করত। অংশগ্রহণ করত শিকারেও। এর আবিষ্কার না ঘটলে মানুষ চামচের ধারণাই পেত না কখনো। 

ডাগেরোটাইপ

ডাগেরোটাইপ হলো প্রথম সাধারণভাবে ছবি ওঠানোর পদ্ধতি। ১৮৪০ থেকে ১৮৫০-এর দিকে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। আজকের পৃথিবীর যে কোনো মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করে রাখবার প্রবণতা আমাদের। প্রতিটি ঘটনা মানুষ ছবিবন্দী করে ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে রাখে। এই ফটোগ্রাফির ধারণা জন্মলাভ করে ডাগেরোটাইপ থেকে।

লুইস-জ্যাক-ম্যান্ডে ডাগেরো এবং জোসেফ নিসেফোর নিয়েপস্। তাদেরই প্রচেষ্টায় ১৮৩৯ সালে পৃথিবী এর সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করে। প্রথমবারের প্রচেষ্টায় নিয়েপসের প্রায় ৮ ঘণ্টা লেগেছে। ডাগেরোর লেগেছিল ২০-৩০ মিনিটের মতো। 

সেদিনের সেই ঘটনার কারণে আজকের পৃথিবী এতটা রঙিন। মৃত পিতার ছবি হাতে নিয়ে কিংবা চলে যাওয়া প্রেমিকার ছবি সামনে রেখে দুঃখ করার সুযোগ পেয়েছে মানুষ। পেয়েছে তার একান্ত ব্যক্তিগত আনন্দের মুহূর্তকে বাঁধিয়ে রাখার সুযোগ।

স্যাক্সোফোন

সংগীতের যন্ত্রপাতির ইতিহাস সাধারণত প্রাচীন। সবচেয়ে প্রাচীন বাঁশির নজিরই খুব সম্ভবত ৩৫,০০০ বছরের পুরনো। ভারতে বেহালা কিংবা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের গল্পও কম পুরাতন না। সে অনুপাতে স্যাক্সোফোনের আবিষ্কার বলতে গেলে আধুনিক। প্রথম স্যাক্সোফোনের পরিচিতি পাওয়া যায় এন্টনি-জোসেফ স্যাক্স-এর মাধ্যমে ১৮৪৬ সালে। 

প্রথম বাদ্যযন্ত্র হিসাবে এখানে রিডের সাথে পিতলের বেলকে সমন্বয় করা। ফলে নিজস্ব শব্দের পাশাপাশি উচ্চনাদ কিংবা বিচিত্র ধ্বনির সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। বস্তুতপক্ষে স্যাক্সোফোন, পরবর্তী অনেক সংগীত যন্ত্রের জন্মের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সংগীতে এসেছে নতুন প্যাটার্ন।

বেসেমার পদ্ধতি

বেসেমার বলতে একটা বিশেষ পদ্ধতিকে বোঝায়, যেখানে কম খরচে শৈল্পিক পর্যায়ে স্টিল উৎপাদিত হয়। প্রক্রিয়ার মূলনীতি হলো অক্সিডেসনের মাধ্যমে লোহা থেকে অবিশুদ্ধতা দূর করা। আধুনিক যুগে নির্মাণে স্টিলের ব্যবহার সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। এর আবিষ্কার ছিল এদিক থেকে বিপ্লবের মতো। 

হেনরি বেসেমার এবং উইলিয়াম কেলি ১৮৪০-এর দশকে এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন পৃথিবীকে। বর্তমানে স্টিলের জন্য অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তারপরেও বেসেমার পদ্ধতি শিল্পের অগ্রসরমানতার দিকে পথিকৃতের মতো। এর মধ্য দিয়েই সম্ভব হয়েছে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা, টাওয়ার কিংবা যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রগতি সাধন।

সেলুলয়েড

সেলুলয়েড প্রথম সংশ্লেষিত প্লাস্টিক। আধুনিক জীবনের দৈনন্দিন কাজে প্লাস্টিক সবথেকে প্রয়োজনীয় উপাদানের মধ্যেই পড়ে। ঘরের ভেতরে ছোট্ট বাটি থেকে শুরু করে বাজার থেকে ফেরার ব্যাগ পর্যন্ত—কোথায় নেই প্লাস্টিক? হালকা এবং সহজে স্থানান্তরযোগ্য হবার কারণে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসাবে আজ অব্দি অন্য কিছুই জনপ্রিয় হতে পারেনি।

১৮৬০-এর দশকে সেলুলয়েডের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন জন ওয়েজলি হায়েট। তারপর থেকে ফিল্ম, নানান ধরনের খেলনা কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যবহারে সেলুলয়েড নিয়ে এসেছে নতুন মহাকাব্য। পৌঁছে গেছে শিল্প-কারখানা থেকে বেডরুমের চৌহদ্দি পর্যন্ত।

ফোনোগ্রাফ

টমাস আলভা এডিসন বিখ্যাত অনেক কিছুর জন্যই। তবে ফোনোগ্রাফের ধারণাটি ছিল যুগান্তকারী। প্রথম দিকের রেকর্ড প্লেয়ার বলে আখ্যা দেওয়া যায় ফোনোগ্রাফকে, যা পরবর্তীতে সংগীতে নয়া মাত্রা যোগ করেছে। সেই প্রযুক্তি হয়তো আধুনিক আইপডের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল, কিন্তু সহজে বহনযোগ্য সংগীতের যুগ শুরু হয় এর মধ্য দিয়েই। 

আগে কাউকে গান শুনতে হলে প্রথমে খুঁজে বের করতে হতো এমন কাউকে, যে গান শোনাতে ইচ্ছুক। শুধু একবার ভাবুন, ‘ইন দ্য এন্ড’ গানটা শোনার জন্য প্রতিবার চেস্টার বেনিংটনকে খুঁজে বের করতে হলে কেমন হতো? ফোনোগ্রাফ তা থেকে মুক্তি দিল খুব সহজে। আর দেখিয়ে দিল নতুন পথ।

রাইট ভাইদ্বয়ের উড্ডয়ন

আবিষ্কারের ইতিহাস থাকবে, অথচ তার তালিকায় রাইট ভাইদ্বয়ের নাম থাকবে না; সেটা কিভাবে সম্ভব? তাদের ঐতিহাসিক উড্ডয়ন পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছে, শুধু স্থলে কিংবা জলে না। মানুষ চাইলে আকাশেও রাজত্ব করতে পারে। উড়তে পারে পাখির মতো। 

১৯০৩ সালে রাইট ভাইদ্বয় প্রমাণ করেছেন, একজন পাইলটের মাধ্যমে প্লেনকে আকাশে ভাসিয়ে রাখা যায়। তার পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। পৃথিবীর মানুষ বর্তমানে আকাশপথকে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছ। আন্তঃনগর কিংবা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে মহাকাশ বিজয়ের।

ইন্টিগ্রেটেড সারকিট

আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের কল্পনা করাই ইন্টিগ্রেটেড সারকিট ছাড়া সম্ভব না। ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবির মাধ্যমে আবিষ্কৃত হওয়া বস্তুটি দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। এমপ্লিফায়ার, মাইক্রোপ্রসেসর, স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটার থেকে গাড়িতে—ইন্টিগ্রেটেড সারকিটের ব্যবহার অনন্য।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/06/1565080189616.jpg

সাধারণত সিলিকন দিয়ে তৈরি ইন্টিগ্রেটেড সারকিটে শত থেকে মিলিয়ন ট্রানজিস্টর, রেজিস্টর এবং ক্যাপাসিটর থাকে। সে যা-ই হোক, ইন্টিগ্রেটেড সারকিটের জন্যই প্রযুক্তির বিপ্লব সম্ভব হয়েছে।

অ্যাপল-II পার্সোনাল কম্পিউটার

১৯৭৭ সালে স্টিফেন ওজনিয়াক অ্যাপল-II উন্মোচন করেন। আর সেই থেকে এই নাম পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত কম্পিউটার হিসাবে মানুষের কাছে এর আগমন ছিল পৃথিবীকে সত্যিকার অর্থেই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এ পরিণত করার সংকেত।

পরবর্তীতে অবশ্য কম্পিউটার আরো ছোট, বহনযোগ্য এবং সক্ষমতা নিয়ে হাজির হয়েছে, কিন্তু এই পথে অ্যাপল-II অগ্রনায়ক। আজকাল পকেটে করে তাবৎ বিশ্বের খবর বয়ে বেড়ানো সম্ভব। একেই বলে বিজ্ঞান। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর