নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিখ্যাত সাত বিতর্ক

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:49:26

নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯০১ সালে থেকে। এরপর দিনে দিনে এটি বিশ্বের সেরা একটি পুরস্কারে ভূষিত হয়ে আসছে। নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময়ে যথাসাধ্য যাচাইবাছাই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় বিধায় এনিয়ে বিতর্কও খুব একটা নেই। তবে একেবারেই যে কোনো বিতর্ক হয়নি এমনও নয়। কখনো যোগ্য প্রার্থীকে রেখে অন্য কাউকে পুরস্কার দেওয়া আবার কখনো বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করার নজিরও আছে। এখানে আমরা নোবেল পুরস্কার নিয়ে তেমনি কিছু গল্প তুলে ধরব যেগুলো মাঝেমধ্যে নোবেল পুরস্কার এবং এর স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

আলফ্রেড নোবেল, “দ্য মার্চেন্ট অফ ডেথ”

নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রথমেই যে বিতর্কটি রয়েছে তা খোদ এর প্রতিষ্ঠাকে ঘিরেই। নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল ছিলেন একজন সুইডিশ বিজ্ঞানী। যিনি ডিনামাইটসহ বেশ কিছু জীবনধ্বংসকারী বিস্ফোরক আবিষ্কার করেন। ফলাফল হিসেবে লোকেরা তাকে সেসময় খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। এমনকি যখন তার ভাই মারা যায় তখন ফ্রান্সের একটি পত্রিকা ভাইয়ের মৃত্যুকে নোবেলের মৃত্যুর সাথে গুলিয়ে ফেলে এবং বড় করে নিউজ করে “The merchant of death is dead।”

◤ নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুর ১৯ বছর পরে ১৯১৫ সালে এমিল ওস্টারম্যানের আঁকা তাঁর একটি প্রতিকৃতি ◢


সেই খবরে এও বলা হয় কিভাবে লোকেদের দ্রুত সময় হত্যা করা যায়, সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করে নোবেল ধনকুবের হয়েছেন। অনেকের ধারণা এই নেতিবাচক সংবাদটি নোবেলকে খুব নাড়া দেয় এবং এর প্রতিক্রিয়াতেই তিনি মানুষের কল্যাণে কিছু করতে আগ্রহী হন। ফলশ্রুতিতে তিনি তার সকল সম্পদ একটি ট্রাস্টের অধীন রেখে সেটা থেকে মানবকল্যাণে যারা অবদান রাখবেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়ে যান।

নারীদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন না করার অভিযোগ

নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রচলিত বিতর্কগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এখানে নারীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নোবেল পুরস্কার মোট ৮৬৪ জন ব্যক্তি এবং ২৫টি সংস্থাকে প্রদান করা হয়। কিন্তু এই দীর্ঘ তালিকাতে বিজয়ীদের মধ্যে কেবল ৪৭ জন নারী ছিলেন, যা মোট নোবেল বিজয়ীর মাত্র ৫%। যার কারণে কেউ কেউ দাবি করেছেন, নোবেল কমিটি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে অবজ্ঞা করে। এই আলোচনাকে আরো উত্তপ্ত করে তোলে জোকলিন বেল বার্নেল-এর নোবেল পুরস্কার না পাওয়া।

◤ ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোসলিন বেল বার্নেল ◢


কেননা জোকলিন বেল বার্নেল ১৯৬৭ সালে পালসার আবিষ্কার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তার উপদেষ্টা অ্যান্টনি হুইশের সাথে যুক্ত হয়ে একত্রে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কেবল হিউশ এবং তার আরেক সহকর্মী মার্টিন রাইলকে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেও জোকলিন বেল বার্নেলকে সে তালিকায় রাখা হয়নি। যে কারণে এই বিতর্কটি তখন আবার সকলের সামনে আসে।

অশান্তিকারীকে শান্তির পুরস্কার

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার হলো নোবেলের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত একটি পুরস্কার। শান্তিতে নোবেলজয়ী অনেক ব্যক্তিকেই অশান্তি সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময় সমালোচিত হতে দেখা যায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলোর মধ্যে ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) নেতা ইয়াসির আরাফাতের শান্তিতে নোবেল বিজয়। ১৯৯৪ সালে তিনি ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ওসলো অ্যাকর্ডে কাজ করার জন্য ইজরায়েলি ইয়েজটক রবিন এবং শিমন পেরেসের সাথে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

◤ সাবেক ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট এবং পিএলও’র প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত [বামে প্রথম] ◢


তবে অনেক সমালোচক উল্লেখ করেছেন, আরাফাত প্রধান থাকাকালীন পিএলও এবং ইজরাইল প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ বাঁধাত। তাই শিমন পেরেস এবং ইয়াসির আরাফাতের একসাথে নোবেল প্রাপ্তি ছিল বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। এ যেন চোরকে চুরি করো আর গেরস্তকে জাগ্রত থাকার মতোই বিষয়।

এডলফ হিটলারকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন

জেনে অবাক হবেন, এডলফ হিটলারের মতো একজন কুখ্যাত খুনিকেও শান্তিতে নোবেল পদকের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে সুইডেনের একজন বিচারক তাকে মনোয়ন দিয়েছিলেন। যদিও তিনি পরে দাবি করেন এটা তিনি নিছক মজা করেই করেছেন। কিন্তু তিনি ছাড়া আর কেউ এটাতে মজাদার কিছুই খুঁজে পাননি। যারফলে পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে এই নমিনেশন তুলে নিতে হয়েছিল। এছাড়াও পরবর্তীতে ১৯৪৫ এবং ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবাজ সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়।

পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া

নোবেল প্রাইজকে অনেকেই একটি সম্মানের পুরস্কার মনে করেন। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এমন নয়। বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে অনেক নোবেল বিজয়ী পুরস্কার নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনি দুজন বিজয়ী স্বেচ্ছায় এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জ্য পল সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। একইভাবে ১৯৭৪ সালে নোবেল পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান লে ডুক থো।

◤ জ্য পল সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন ◢


যিনি হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটাতে কাজ করেন। তাদের কাজের জন্য নোবেল কমিটি তাদেরকে শান্তি পুরস্কারটি প্রদান করে। কিন্তু থো অবশ্য তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি তখন ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।” আর এই কারণে তিনি শান্তি পুরস্কার নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এরফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেন। জানুয়ারি, ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধবিরতির আলোচনা এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাঁদেরকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু যখন এ পুরস্কারের বিষয়টি ঘোষিত হয়, তখনও উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত ছিল। অনেক সমালোচকদের অভিমত, কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন।

নোবেল প্রাইজ নিতে বাধা দেন হিটলার

হিটলারের কাজের সমালোচক জার্মান সাংবাদিক কার্ল ফন অসিয়েটজকিকে ১৯৩৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে হিটলার সমস্ত জার্মানকে নোবেল পুরস্কার গ্রহণে বাধা প্রদান করেন এবং বিকল্প হিসাবে শিল্প-বিজ্ঞানের জন্য জার্মান জাতীয় পুরস্কার তৈরি করেছিলেন।

◤ কার্ল ফন অসিয়েটজকি ◢


যারফলে জার্মান সাংবাদিক কার্ল ফন অসিয়েটজকিকে সেসময় পুরস্কার নিতে দেওয়া হয়নি। এছাড়াও রিচার্ড কুহন (১৯৩৮, রসায়ন), অ্যাডলফ বুটেনান্ট (১৯৯৯, রসায়ন), এবং গারহার্ড ডম্যাগ্ক (১৯৯৯, পদার্থবিজ্ঞান বা চিকিত্সা) তাদের নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তারা পরে তাদের স্বীকৃতিপত্র এবং পদক পেয়েছিল।

স্পন্সরদের খুশি করার জন্য পুরস্কার দেওয়ার অভিযোগ

২০০৮ সালে হ্যারাল্ড জুর হাউসেন হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার এই গবেষণা সার্ভিকার ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এতে কি সমস্যার কিছু দেখছেন না? আছে। এখানেও সমস্যা আছে। এমনি এমনি তো আর এত সমালোচনা হয়নি এনিয়ে।

◤ হ্যারাল্ড জুর হাউসেন ◢


হ্যারাল্ড জুর হাউসেন যেই ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেছিলেন অর্থাৎ এইচপিভি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটটি স্পন্সর করেছিল। এছাড়াও জুর হাউসেনকে যেই প্যানেল নির্বাচিত করেছিল, সেই প্যানেলের দুই সদস্যের ভ্যাক্সিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে সম্পর্ক ছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। সত্য কখনোই চাপা থাকে না। বলা বাহুল্য, এই ঘটনাটিও চাপা থাকেনি বেশিদিন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর