নবনীতা দেবসেন বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন

, ফিচার

জাভেদ পীরজাদা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 19:42:27

বাংলা সাহিত্যের লেখক নবনীতা দেবসেন মারা গেছেন গতকাল (৭ নভেম্বর)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। পদ্মশ্রী-সম্মানে ভূষিত লেখিকা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ কলকাতায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন নবনীতা দেবসেন। নরেন দেব ও রাধারাণী দেবীর কন্যা, নবনীতা দেবসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল থেকে পাশ করার পর ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এরপরে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছেন তিনি। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যান হারভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। ১৯৭৬ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাদের দুই কন্যা অন্তরা দেবসেন ও নন্দনা সেন। নবনীতা দেবসেনকে ‘নটী নবনিতা’ বইটির জন্য ১৯৯৯ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার। ২০০০ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য—ভালোবাসার বারান্দা, হে পূর্ণ তব চরণের কাছে ও ট্র্যাকবাহনে ম্যাকমোহনে। নবনীতা দেবসেনের মৃত্যুতে শোকাহত সংস্কৃতি জগত। তিনি মারা যাওয়ার পর গণমাধ্যমকে অমর্ত্য সেন জানালেন, ডিভোর্সের পরও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে।

বৃহস্পতিবার নবনীতা দেবসেন মারা যাওয়ার পরই নবনীতা ও অমর্ত্য’র সম্পর্ক ভাঙনের জন্য অমর্ত্য সেনকে দায়ী করে ফেসবুকে ট্রল শুরু হয়। অমর্ত্য সেন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। শুক্রবার তিনি বিবিসি ও দ্য ওয়াল গণমাধ্যমকে টেলি-সাক্ষাৎকারে জানান, তাদের সম্পর্ক ডিভোর্সের পরও ভালো ছিল। যাদবপুর বিশ্বাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রেই দুজনের আলাপ। সেখানেই গড়ে উঠেছিল সম্পর্ক। তারপর বিয়ে। কিন্তু বিচ্ছেদও হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। তিনি জানান, তাদের দুই কন্যা অন্তরা দেবসেন ও নন্দনা দেবসেনের জন্যই নিয়মিত যোগাযোগ ছিল নবনীতা দেবীর সঙ্গে। গত সপ্তাহে তাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে। নবনীতার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। তাদের মেয়ে দুটি মা নবনীতা দেবসেনের কাছে থাকতেন। তিনি বলেন, নবনীতার লেখা, চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তিবোধ সবই আমাকে মুগ্ধ করত। কিন্তু তারপরও সংসার টিকেনি। আমার মেয়ে দুটোর মা হিসেবে আমি এখনো তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার মৃত্যু আমাকে অনেক স্মৃতিকাতর করছে। আফসোস, শেষ দেখা হলে ভালো লাগত।

নবনীতা দেবসেনের বাবা ছিলেন কবি নরেন্দ্র দেব। মা রাধারানী দেব। হিন্দুস্থান পার্কে তাদের ‘ভালোবাসা’ নামের বাড়িতেই ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে জন্ম নবনীতার। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম রেখেছিলেন ‘নবনীতা’। কবি দম্পতির স্নেহচ্ছায়া আর আদ্যেপান্ত সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হওয়া। গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ১৯৫৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসটিংশন নিয়ে আবার এমএ পাশ করেন সাহিত্যের এই কৃতী ছাত্রী। পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পোস্ট ডক্টরেট ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেসব সময়ের স্মৃতি প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলেন, আমাদের সেই সময়গুলো ছিল দুর্দান্ত। আমরা একাডেমিক বিষয়গুলোর চিন্তাভাবনাও একে অপরকে শেয়ার করতাম। একসময় আমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে কলকাতার অনেকেই ঈর্ষাকাতর ছিলেন। নবনীতা ১৯৭৫ থেকে ২০০২ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামুলক সাহিত্য বিভাগে। ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

ডিভোর্সের পরেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল নবনীতা দেবসেন ও অমর্ত্য সেনের মধ্যে


 

অমর্ত্য সেন যেমন বাংলাদেশের পক্ষে সবসময় কথা বলেছেন সেরকম নবনীতা দেবসেনও ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু। ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী তার ‘বন্ধু স্মরণ’ বইতে নবনীতা প্রসঙ্গে এভাবে লিখেছেন, “১৯৭৩ সালের শেষদিকে আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আমাকে কয়েক মাস কলকাতায় থাকতে হয়েছিল। তখন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের এক বন্ধুর মাধ্যমে ড. অমর্ত্য সেনের স্ত্রী নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি তখন পিতামাতার সঙ্গে তাদের কলকাতার বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। তার পিতামাতাও ছিলেন স্বনামখ্যাত কবি ও লেখক। কবি নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী দেবী। বাংলায় ওমর খৈয়ামের কবিতা প্রথম অনুবাদ করে তারা খ্যাতি অর্জন করেন। অমর্ত্য সেন তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। নবনীতা দেবসেনের সঙ্গেও তার ছাড়াছাড়ি হয়নি। আমি বিকালের দিকে অবসর পেলেই নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী দেবীর বাসায় ছুটে যেতাম। তাদেরও দেখা পেতাম। এমন সুখী দম্পতি জীবনে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বৃদ্ধ বয়সেও তারা দুজনে দুজনের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছেন মনে হতো। কিন্তু তাদের মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি। অমর্ত্য-নবনীতার দাম্পত্য জীবন টেকসই হয়নি। সে কথা থাক। নবনীতা দেবসেন শুধু একজন ভালো কবি নন; একজন মেধাবী, মননশীল বুদ্ধিজীবীও। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় মুগ্ধ হতাম।

একদিন নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে তাদের বাসায় বসে আলাপ করছি। তিনি কথা প্রসঙ্গে বললেন, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় নজরুলের কাব্যদর্শন শেখ মুজিবের রাষ্ট্রীয় নীতিকে বেশি প্রভাবিত করেছে। এই দর্শনটি ধর্মনিরপেক্ষতার নয়, ধর্ম সমন্বয়ের।

বলেছি, আমি যতদূর জানি, বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত অনুরাগী। নইলে তার সোনার বাংলা গানকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিতেন না। নবনীতা বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ হয়তো তার অন্তরে প্রেরণা জোগান। কিন্তু তার রাজনৈতিক মানস গঠিত হয়েছে নজরুলের বিদ্রোহ-বিপ্লবের মন্ত্র দ্বারা। নজরুল চিরকাল মৌলবাদ ও মোল্লাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। বরং কৌতুক করে হলেও কবিতায় টিকি ও দাড়ির মিলন চেয়েছেন। শেখ মুজিবেরও লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু আপাতত তার যাত্রা ধর্ম সমন্বয়ের দিকে। তার পররাষ্ট্রনীতিতেও এর প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে এমন বৈরি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সখ্য স্থাপনকে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

আমি এ ব্যাপারে নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করিনি। আমারও মনে হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম একমাস কি দুমাস ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল। বেতার-টেলিভিশনে ধর্মগ্রন্থ পাঠ, ধর্মীয় কায়দায় কুশল কামনা করা বর্জন করে শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা বা শুভ রাত্রি বলা শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে শাসনভার গ্রহণ করার পর আবার বেতার ও টেলিভিশনে আগের ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজগুলো ফিরে আসে। কেবল পবিত্র কোরআন পাঠের সঙ্গে যুক্ত হয় বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাঠ। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ধর্ম সমন্বয়। নবনীতা দেবসেন আমাকে বলেছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। কথা বলতে চান। পরে আরেকজনের মাধ্যমে জানতে পারি নবনীতা দেবসেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের ভুয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে একটি অসাম্প্রদায়িক উন্নত বাংলাদেশ চাইতেন।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর