ফোন যত বেশি দূরে মস্তিষ্ক তত বেশি কার্যকর

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 17:02:39

প্রতিদিন সকালে ঘুম ঘুম চোখে আমরা সবার আগে যা খুঁজি তা হলো আমাদের মোবাইল ফোন। ঘুম জড়ানো চোখে ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি না করলে আমাদের ঘুমের পূর্ণতা আসে না। গবেষণায় জানা গেছে ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমানোর আগে একজন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী গড়ে ৮৭ বার ফোনটি হাতে নেয়। মোবাইল ফোন জড়িয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে। কিন্তু এভাবে মোবাইল-নির্ভরতা আমাদের জন্য কতটা উপকারী? নাকি আমরা বড় ক্ষতি করে চলেছি নিজেদের?

মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। যে কোনো কাজেই এখন মোবাইলে ফোনের দরকার পড়ে। মোবাইল ফোন বাঁচিয়ে দিচ্ছে আমাদের মূল্যবান সময়। কমিয়ে দিচ্ছে দূরত্ব। পাশাপাশি কেড়ে নিচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত অবসর। গবেষণা বলছে মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে আমাদের করে দিতে পারে মেধাশূন্য।

চমকে গেলেন? সম্প্রতি চমকে যাওয়ার মতোই একটি তথ্য দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজিউমার রিসার্চ-এর জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষকরা ৪৪৮ জন স্নাতক শিক্ষার্থীকে মেধার ক্ষমতা পরিমাপের জন্য পরিকল্পিত পরীক্ষা নিতে বলেছিলেন। যেখানে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট পন্থায় কিছু গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে দিতে বলা হয়। গবেষকরা পরীক্ষার্থীদের তিনটি আলাদা গ্রুপে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেককে তাদের ফোনটি সরিয়ে রাখতে বলেন। অর্থাৎ ফোনকে কিছু সময়ের জন্য বিদায় জানিয়েই পরীক্ষাটি সম্পন্ন করতে হবে। ফোন সরিয়ে রাখার জন্য তিনটি দলকে আলাদা তিনটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। প্রথম দলকে বলা হয় তারা যেন একটু দূরে ফোন রেখে কাজ করে। দ্বিতীয় দলকে ব্যাগে বা ডেস্কের নিচে রাখতে ফোন রাখতে বলা হয়। তৃতীয় দলকে বলা হয় রুমের বাইরে অন্য কোথাও ফোন রেখে আসতে।

ফলাফল কী জানেন? যাদের ফোন অন্য রুমে ছিল তারা সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করেছে। যাদের ফোন ডেস্কে ছিল তাদের চেয়ে—যাদের ফোন একটু দূরে ছিল, তারাও উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো পারফরম্যান্স করেন। এককথায়, যাদের ফোন যত দূরে ছিল তাদের মস্তিষ্কের কাজ তত ভালো ছিল।

এখন আপনার মনে হতে পারে যদি ফোন পাশে থাকে এবং তা বন্ধ করে রাখি তবে তা আমাদের জন্য কোনো অকল্যাণ বয়ে আনবে না। তাহলে দেখুন গবেষণা কী বলে। আগের পরীক্ষায় আমরা দেখেছিলাম শিক্ষার্থীদের তিনটি শর্ত দিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছিল। তারপর শিক্ষার্থীদের আবারও তিনটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয় আরেকটি পরীক্ষা। যেখানে একটি দলকে ডেস্কে বা পকেটে ফোন চালু রেখে পরীক্ষা দিতে বলা হয়, আরেকটি দলকে বলা হয় ফোন বন্ধ করে পকেটে রাখতে। তৃতীয় দলকে বলা হয়েছিল মাঝেমাঝে ফোন অন অফ করে পরীক্ষা দিতে।

অবাক করা বিষয় হলো ফোন অন কিংবা অফ থাকা এই পরীক্ষায় আলাদা কোন প্রভাব ফেলেনি। এর মাধ্যমে প্রমাণিত যে, ফোন অন বা অফ করা সমাধান নয়, বরং ফোন দূরে রাখাই আসল কথা। ফোন যত দূরে থাকবে, মানুষের মস্তিষ্ক তত ভালো কাজ করবে।

মনোবিজ্ঞান জার্নালে ২০১৫-এর একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছিল, কিছু জানার দরকার পড়লে সার্চ ইঞ্জিন থেকে তা জেনে নেওয়া যাবে বিধায় নতুন কিছু জানার আগ্রহ কমে যাচ্ছে মানুষের। এমন মনোভাব ও সিদ্ধান্তের প্রভাবে আমাদের মস্তিষ্কও অভ্যস্ত হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে না রাখায়। যেহেতু সংরক্ষণের জন্য ফোন আছে।

মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন ঘাঁটাঘাঁটির কারণে কমে গেছে আমাদের ঘুমের পরিধিও। আর পর্যাপ্ত ঘুম যদি না হয়, স্বাভাবিকভাবেই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। স্মৃতিশক্তি যেমন লোপ পায়, তেমনি দেখা দেয় মনোযোগ এবং বুদ্ধির ঘাটতিও। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে নানাবিধ ডিজিজ-এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

মুঠোফোন ঠিক জায়গায় ও পর্যাপ্ত চার্জসহ আছে কিনা তা নিয়ে আমাদের মন সবসময় সতর্ক থাকে। আমাদের মনের মোবাইল হারানোর বা চার্জ ফুরানোর ভয় থেকে তৈরি হয়েছে মনেরই আরেক নতুন রোগ। মনোবিজ্ঞানীরা এই রোগের নাম দিয়েছেন ‘নোমোফোবিয়া (নো মোবাইল-ফোন ফোবিয়া)’। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৫৩ শতাংশ এবং ২৯ শতাংশ ভারতীয় তরুণরা এ রোগের শিকার। পাঁচ বছর আগেও যে রোগের অস্তিত্ব ছিল না, সে রোগ নিয়েই আজ দেশে-বিদেশে চিন্তিত মনোবিজ্ঞানী-মহল। এককথায় তারা অতিরিক্ত মুঠোফোন-নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেন।

মুঠোফোন-নির্ভরতা কিভাবে কমাবেন


মুঠোফোন-নির্ভরতা কিভাবে কমাবেন এবং কিভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য আপনার মনকে প্রস্তুত করে তুলবেন? ইন্ডিপেন্ডেন্ট ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ বিশেষজ্ঞরা তিনটি সহজ পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন—

এক. যখন ফোন ব্যবহার করবেন, চারদিকে সীমানা নির্ধারণ করুন। একটি নিয়ম প্রণয়ন করুন যে, বিছানায় থাকার সময় আপনি আর ফোনটি ব্যবহার করবেন না, বা রাতের খাবারের টেবিলে আপনি ফোনটি আনবেন না। ছোট ছোট এমন কিছু নো ফোন জোন তৈরি করা আপনার অভ্যাস পরিবর্তনে সহায়ক হবে।

দুই. সমস্ত অ্যাপের নোটিফিকেশন বন্ধ করুন। নিজে যখন অবসর পান তখন একবার চেক করে নিন। এভাবে নোটিফিকেশনের দ্বারা পরিচালিত হওয়া বন্ধ করতে পারেন। রাতে বিছানার পাশে মুঠোফোন না রাখার পরামর্শ গবেষকদের।

অবশেষে, নিজেকে পরীক্ষা করুন। আপনার ফোনটি ছাড়া আপনি কতক্ষণ থাকতে পারেন তা দেখুন। আপনি কি একঘণ্টা দীর্ঘ টিভি শো দেখে কাটাতে পারেন? একটু না হয় মুদি দোকান থেকেই ঘুরে আসুন। আপনাকে চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখবেন আপনি যত বেশি চেষ্টা করবেন ততই আপনি দেখতে পাবেন মোবাইল ছাড়া চলাফেরা যতটা কঠিন মনে করছিলেন আসলে তা নয়। বরং এটি খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।

এ সম্পর্কিত আরও খবর