কে সেজেছে সাজেকে?

, ফিচার

আবু আফজাল সালেহ | 2023-08-30 03:10:49

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পার হতেই শুরু হয়েছে আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু রাস্তা। বুঝতে বাকি নেই পার্বত্য অঞ্চলে ঢুকে পড়েছি। গুইমারা অঞ্চল। মানিকছড়ি উপজেলা। চট্টগ্রাম থেকে যেতে খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার। পুরো জেলা তো পর্বতময়! শৈল জেলা। আলুটিলা পাহাড়। দীঘিনালা পেরিয়ে রাঙামাটির পাহাড়। তারপরেই সাজেক ভ্যালি। এর চমৎকার অংশটি রুইলুই পাড়া। রুইলুই পাড়ার ডানদিকে মিজোরামের পর্বতশ্রেণি। লুসাই পাহাড়ও আছে। সাজেক আর্মি ক্যাম্প ছাড়িয়ে এ এলাকার সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া কংলাক। মেঘ আটকে যায় পাহাড়ভাঁজে। লালপাহাড়ের দেশ। সকাল-দুপুর-রাতে, বৈচিত্র্যময় দৃশ্যের অবতারণা হয় সাজেকে।

সাজেক যাওয়ার পথে হাত নাড়িয়ে অভিনন্দন জানায় পাহাড়ি শিশু 

মেঘ বলে যাব যাব
সাজেকের অনেক জায়গা থেকে মেঘবালিকাদের উড়তে দেখা যায়। আমাদের উপরে আর নিচে মেঘ ভেসে যায়। মেঘ বলে যাব যাব, আমরা বলি আরো থাকো। ভাসতে থাকা মেঘেরা বলে পেছনের দিকে আছে আরো। সূর্যের ঝলমলে আলো। মেঘের প্রতিফলিত আলো এক চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করে। লাল সাদা নানা ফুল ফুটে আছে সমগ্র সাজেকে। রিসোর্ট আর মেইন রোডের সাথেই। এসবের মধ্যেই শুভ্রশাদা মেঘের সারি! এক মোহনীয় দৃশ্য! চম্বুকময়তার আবেশজড়ানো পরিবেশ কখনো ভুলে যাওয়ার নয়!

সকালের সাজেক
রোজ সকালে বা ভোরবেলাতে রুইলুই পাড়াজুড়ে মেঘ ভাসে। সড়ক থেকে স্পর্শদূরের পুঞ্জ-পুঞ্জ মেঘ দেখাটা আসলেই মজাদার। মেঘবালিকারা মাঝরাত থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত প্রচণ্ডরকমের খেলায় মত্ত। ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে চলে যায় কেউ কেউ। দুপুরে পাহাড় আর উপত্যকায় সাদামেঘেদের মধ্যে সবুজের ওপর অনিন্দ্য খেলা চলে। আর বিকালে সবুজের ওপর দিয়ে সাদা ধোঁয়া উড়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ।

বিকালের সাজেক
বিকালবেলা পাহাড়ের সবুজ অংশটি অন্যরকমভাবে দৃশ্যমান হয়। আর তার দৃশ্যপটে ক্ষণে ক্ষণেই খণ্ড-খণ্ড মেঘবালিকাদের উড়ে যাওয়া অন্য এক ইশারা জাগিয়ে দেয়। রাস্তার ধারে বা রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে এসব দৃশ্য অন্যসব চিন্তাকে তাড়িয়ে দেবেই। ক্ষণে ক্ষণে মনে হবে, যেন মেঘ ভাসে না আমরা ভাসি। আমরাই মনে হয় সাদামেঘের সাথে ভেসে যাচ্ছি! চা কিংবা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ ডাক, আমার মোটরবাইকার কাম গাইডের! স্যার, হ্যালিপ্যাডে উঠি? সন্ধ্যা রাতের দৃশ্য বড়ই চমৎকার! তাছাড়া আজ তো পূর্ণিমা রাত। সোনায় সোহাগা! ওহ, ‘তাই তো, তাই তো’ এই শব্দগুলি নিজের অজান্তে বলতে বলতেই রাস্তার পাশের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

সন্ধ্যায় সাজেক
এরপর হ্যালিপ্যাডে উঠলাম। আরো লোকজন আছে সেখানে। প্রেমিক-প্রেমিকাও আছে। যুগলবন্দীও কয়েকজনকে দেখলাম। বাচ্চারা হইহুল্লোড় করছে। তারপরেও নির্জন-নিরিবিলি। পাহাড় ঘুমায়, চাঁদ পাহারা দিচ্ছে। রুইলুই পাড়ায় আলো ও সুরের খেলা চলছে। এখানেও দলছুট তরুণদের কণ্ঠ ভাসে। রোমান্টিক গানে। আনমনেই আমি কিছু কিছু অংশে কণ্ঠ মিলিয়ে দিলাম। আজ দেখার কেউ নেই। আজ আমি অফিসার না! আমিও তরুণ। আমি দলছুটও। এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাদের সাথে শুরু করলাম—‘লাল পাহাড়ের দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা... এক্কেবারে মানাইছে না রে, এক্কেবারে মানাইছে না রে...’।

রাতের রুইলুই পাড়া
রাতে সমগ্র রুইলুই পাড়া জেগে ওঠে। হ্যালিপ্যাডে তরুণ-তরুণী এবং পর্যটকদের জীবন্ত আড্ডা। হঠাৎই ভেসে এলো সুর, ‘লাল পাহাড়ের দেশে যা... এক্কেবারে মানাইছে না রে...’। উদ্যমী তরুণদের সুর মায়া সৃষ্টি করে পাহাড়ে। জ্যোৎস্নারাতে চাঁদকে একবার সামনে আবার পেছনে রেখে সেলফি কিংবা ছবি তোলার মজাটাই আলাদা। লুসাই আর সাজেকের বিভিন্ন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মিটিমিটি আলো। কী অপরূপ! যেন আলো-গ্লাসে তৈরি। রুইলুই পাড়াকে মনে হয় স্বচ্ছ আয়নার উপর আলোর খেলা। হ্যালিপ্যাড থেকে অবিভূত হতে হয় এ নান্দনিক দৃশ্য দেখে। আমি তো রীতিমত অবাকই হয়েছিলাম। কী নিদারুণ দেখতে, তাদের চোখগুলো (আলোর বাতি ) টানা টানা...।

রুইলুই পাড়ায় স্বাগতম

রুইলুই পাড়ায় আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। পেছনেই লুসাই পাহাড়ের পাদদেশ। সেখানে অবিরাম মেঘের ওড়াউড়ি। সবুজের মধ্যে সাদা ভেলা। পাহাড়ি শিশুরা খেলা করছে। ‘পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার হার বেড়ে গেছে’—তারই প্রমাণ মেলে। বাচ্চারাও আমাদের সাথে কথা বলছে। বাংলাও বুঝতে পারছে।

পাহাড় থেকে পাহাড় দেখা
কংলাক পাহাড় থেকে সাজেক ভ্যালি, মিজোরাম পাহাড়শ্রেণি, লুসাই পাহাড় দেখা চমৎকার। বিকাল বেলায় অনেকাংশই পরিষ্কার। বিশেষ করে সাজেক ভ্যালি পরিষ্কার দেখা যায়। লুসাই বা মিজোরামের পাহাড়ে মেঘের ভেলা।

পেছনে লুসাই পাহাড়। মেঘ উড়ছে 

পাহাড়ে আছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার। বাড়িঘরেও এসেছে বৈচিত্র্য ও আধুনিকতার ছোঁয়া। জনসমাগমেও আসছে অনেক নৃগোষ্ঠী। বাঙলিদের সাথে এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর বৈষম্যও কমছে ধীরে ধীরে। সাজেকের এলাকা বৈচিত্র্যে ভরপুর। আবেশি দৃশ্যের ঘন ঘন পরিবর্তন। সকাল-দুপুর-বিকালে ভিন্ন, ভিন্ন দৃশ্য! রাতে ও ভোরে অন্যরকম ভালোলাগার ছোঁয়া! সবসময় বৈচিত্র্যপূর্ণ এক চম্বুকীয় আবেশ যেন আছে এখানে!

যাতায়াত
চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে খাগড়াছড়িগামী বাস পাবেন। সময় লাগবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। বায়েজীদ বোস্তামি থেকে শান্তি পরিবহনে গেলে সময় কম লাগবে। আরামদায়কও হবে। ভাড়া একটু বেশি পড়বে। ২০০ টাকা। এছাড়া ঢাকার গাবতলি বা সায়দাবাদ থেকে সকাল ও রাতে খাগড়াছড়িগামী বিভিন্ন পরিবহন পাবেন। ভাড়া ৫৫০ টাকা। কিংবা ট্রেনে চট্টগ্রামে গিয়ে তারপর বাসে খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন। এরপর চান্দের গাড়িতে রুইলুই পাড়া। দুরত্ব প্রায় ৫০ কি.মি।

চান্দের গাড়িতে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৫০ কি.মি

চান্দের গাড়ি
রুইলুই পাড়া বা সাজেকে যেতে হলে স্থানীয় চান্দের গাড়িতে যেতে হবে। ১০-১৫ জনের ব্যবস্থা এক গাড়িতে। ভাড়া এক দিন-রাতের জন্য ৮,০০০ টাকা। ৩-৪ জনের মাহেন্দ্র ভাড়া ৪,০০০ টাকা। একজন বা দুজন থাকলে মোটরবাইকে দুই হাজার টাকা নেবে। সবক্ষেত্রে রিজার্ভ করতে হয় এবং সময় ভেদে ভাড়া কম-বেশি হয়। চান্দের গাড়ি খাগিড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাওয়া যাবে। মাহেন্দ্র বা বাইক দীঘিনালায়ও পাওয়া যাবে। খাগড়াছড়ি বা দীঘিনালায় থাকা ও খাওয়ার চমৎকার সব ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন বাজেটের ব্যবস্থায় ইচ্ছেমত পছন্দ করতে পারবেন।

চান্দের গাড়ি

যাতায়াতের সময়সূচী
রুইলুই পাড়া যেতে হলে বাঘাইহাট আর্মিক্যাম্প থেকে নাম এন্ট্রি করতে হবে। গাড়িও এন্ট্রি করতে হবে। পর্যটকেরা দিনে দুবার সাজেক এলাকার দিকে যেতে পারবেন। সকাল ১০টায় ও বেলা ৩টায় বাঘাইহাট ক্যাম্প থেকে একত্রে যাত্রা করতে হবে। ফেরার সময় রুইলুই পাড়ায় উল্লিখিত একই সময়ে এন্ট্রি দেখিয়ে যাত্রা শুরু হবে। যাওয়া-আসা উভয়ক্ষেত্রে মাসালং আর্মিক্যাম্পে রিচেকিং হবে। সাজেকগামী বা দীঘিনালাগামী উভয়জায়াগার পর্যটকরাই মাসালং-এ একত্রিত হন। মিলনমেলা বলা যায়। উভয়ক্ষেত্রে পুলিশস্কর্টের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়। আর্মিরা মোড়ে মোড়ে থাকেন। দারুণ লাগে এ অনুভূতি।

ম্পেশাল
পাহাড়ি খাবার খাওয়া যাবে এ পর্যটন এলাকায়। ব্যাম্বু টি বা পাহাড়ি মুরগির মাংসের স্বাদ ভালোই লাগে। এ এলাকা ব্যাম্বু চিকেনের সুবাসে ভরপুর। পেঁপে খেতে দারুণ মজা। নরম আখের রস সস্তায় পাবেন। পাহাড়ি আদিবাসীদের নৃত্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খুব সমৃদ্ধ। অর্ডার দিয়ে এসব খাবার বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। কলার স্বাদ নিতে ভুল করা যাবে না। পুরো এলাকায় মাঝেমধ্যে পথের ধারে পাহাড়ি ফলমূলের পসরা বসায় পাহাড়ি মেয়েরা। রুইলুই পাড়ায় লুসাই মেয়ের হাতের ‘ব্যাম্বু টি’খেতে ভিড় থাকে। রাতের বেলায় বেশি ভিড় থাকে।

লুসাই মেয়ের হাতের ব্যাম্বু টি

সতর্কতা
পাহাড়িদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের। আর্মিক্যাম্প এলাকায় ছবি তোলা নিষিদ্ধ। এ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। সৌর বিদ্যুৎ রয়েছে। অতিরিক্ত মোবাইল এবং ক্যামেরার ব্যাটারি বা চার্জার ব্যাংক নিতে হবে। চার্জ দেওয়ার সুবিধার্থে সীমিত সময়ের জন্য কটেজ এবং হোটেলে জেনারেটর চালু করেন সংশ্লিষ্ট আবাসিক কর্তৃপক্ষ।

থাকা ও খাওয়া
থাকা ও খাওয়ার জন্য রুইলুই পাড়ায় রিসোর্ট আছে। লুসাইগ্রামে ৩-৪ হাজার টাকায় গাছ বাড়িতে থাকতে পারবেন। লুসাই পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ অরণ্যঘেরা কটেজে থাকার অনুভূতিই আলাদা। মেঘের মধ্যেই থাকা যাবে। মেঘ দেখা যাবে, ছোঁয়া যাবে, ধরা যাবে! আদিবাসীদের কুটিরেও থাকতে পারবেন। দামদর ঠিক করে কটেজ/কুটিরে থাকা যাবে। ছুটির দিনে ও পিক সিজনে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো। বিভিন্ন দাম-মানের রিসোর্ট বা কটেজ রয়েছে পুরো এলাকায়।

রুইলুই পাড়ার একটি রেসটুরেন্ট

রাতের রুইলুই পাড়া। টুকটুকে লাল ফুল, টিয়া-রঙের ঝকঝকে কলাপাতার ফাঁকে মেঘবালিকারা। মোহিনীয় দৃশ্য। বাঁশের চা ও পাহাড়ি মোরগের গোস্ত। লুসাই মেয়ের হাতে চায়ের স্বাদ অনেক দিনই মনে পড়বে। গাছবাড়িতে একদিন থাকার স্মৃতি আর কালচারাল প্রোগ্রাম ও উপজাতীয় খাবারের স্বাদ অনেক দিন মনে থাকবে।


আবু আফজাল সালেহ
উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড-কুষ্টিয়া

এ সম্পর্কিত আরও খবর