জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৯ সালে। পেশাগত কারণে ১৯৯৭ সালে ভারতের আসাম রাজ্যে যাই। সেখানে হাইলাকান্দি নামের একটি জায়গা আছে। সেখানকার এমএলএ কংগ্রেসের গৌতম রায়। তাঁর বাসাতে একদিন দুপুরবেলা গৌতম রায় পরিচয় করিয়ে দেন সুলতান চৌধুরীর নামের একজনের সঙ্গে। সুলতান চৌধুরী কথা প্রসঙ্গে জানতে চান, আমি জামিলুর রেজা চৌধুরীকে চিনি কিনা!
আমি বলি, উনার মতো এত বিদ্বান ও বিখ্যাত মানুষকে না চিনে উপায় আছে! বলি তিনি আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন। একজন নামকরা প্রকৌশলী। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তিনি করেছেন। তিনি প্রথম সাইক্লোন সেন্টার তৈরির নেতৃত্ব দেন।
তখন সুলতান চৌধুরী জানান, তিনি জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাই। আমি অবাক হই।
সুলতান চৌধুরী জানান, পরের বছর তিনি আমাদের দেশে আসবেন বেড়াতে। আমার সেলফোন নাম্বার নিয়ে রাখেন। কিন্তু পরের বছর আর উনি আসেননি। ১৯৯৯ সালে কোনো এক সন্ধ্যায় তিনি আমাকে কল করেন। জানান, তিনি ঢাকা এসেছেন। জামিলুর রেজা স্যারের বাসায় উঠেছেন। অনুরোধ, যেন দেখা করি। পরদিন শুক্রবার ছিল। সকালের দিকে আমি জামিলুর রেজা চৌধুরীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় চলে যাই। সম্ভবত দোতলা বা তিনতলা বাসা। বাসার সামনে বিশাল লন। বাটা সিগন্যাল থেকে ন্যুমার্কেটের দিকে যেতে মল্লিকা সিনেমাহলের একটু আগে ডান দিকে তাঁর বাসা। সিনেমা হলটি এখন নেই মনে হয়। তো, সেদিন তার ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয়। সিলেটের শ্রীমঙ্গলে বাসা জেনে হেসে বললেন, ‘আমিও সিলটি।’
আমি তাঁর এ পরিচয়ও জানতাম। বিকাল অব্দি ছিলাম। জামিলুর রেজা চৌধুরীও তার হাইলাকান্দির স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন। জানালেন ওই ছোট শহরটাকে খুব মিস করেন। ভাইদের। কৈশোরে শেষ গিয়েছিলেন। বলেছিলেন যদি আবারও কখনো যদি যাই তবে তাকে জানিয়ে যেন যাই। তবে আমার আর যাওয়া হয়নি। সেদিনই তিনি জানান, চিনুয়া আচেবে তার প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন। থিংকস ফল এপার্ট বইটি তিনি দুবার পড়েছেন।
এরপর তাঁর ভাই সুলতান চৌধুরীর সাথে প্রায়ই কথা হতো ফোনে। গতকাল জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদ জানার পর জানি না কেন, এই মহামারিকালে সুলতানকে এই খবরটি জানানোর ইচ্ছা হলো না, তবে হাইলাকান্দির পরিচিত আরেকজনকে জানিয়ে দিলাম এ মৃত্যুসংবাদ। আশা রাখি সুলতান এ শোকের খবর এরই মাঝে পেয়েছেন।
২০০০ সালের দিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জন্মলগ্নে জামিলুর রেজা চৌধুরী উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। বুয়েটে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক বছর আগেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্নে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাড়ার সময় এটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে। সেসময় ব্র্যাকের হেড অফিসে কাজ করতেন লেখক ও বন্ধু জিয়া হাশান। একদিন পত্রিকাতে দেখি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া বিভাগে লোক নেবে। কী মনে করে, আমি জিয়া হাশানকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন ওখানে নাট্যজন প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুনের ভাইয়ের ছেলে কাজ করছেন। তিনি প্রসঙ্গক্রমে জানলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী আমার পরিচিত।
কিন্তু কেন যেন আমি জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ওই পদে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারিনি। এরমধ্যে তিনি একদিন ফোনও দেন। কী করছি, কেমন আছি এসবের খবর নেন। কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারিনি।
জামিলুর রেজা চৌধুরীর সাথে আরেকদিন আমার দেখা রমনা পার্কে। সকাল বেলা। তখন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান নূরও হাঁটতেন নিয়মিত। তাঁরা দেখা হলে একসাথেই হাঁটতেন। আমি অবশ্য আড়ালে থাকতাম। তো রমনা পার্কে জামিলুর রেজা চৌধুরীকে দেখি একা হাঁটছেন। এগিয়ে যাই। কথা বলি। সেবছর মানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে তিনি একুশে পদক পান। তাঁকে অভিনন্দন জানাই। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে অভিনন্দন জানানোর পর স্মিত হেসে শুধু বলেছিলেন, ‘একটু দেরি হয়ে গেল না!’
২০১৮ সালে সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু, ট্যানেল তৈরিতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বড় বড় প্রকল্প, যেমন স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপিতে কাজ করেছেন। যতদূর জানি তাঁর মতো একজন নির্মোহ মানুষ কখনোই ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। কথাটা এ কারণেই বললাম, তাঁকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও ভিসি হওয়ার অফার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি হননি। কারণ রজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতজানু থাকতে হয় বলেই হননি।
তিনি এই শহরকে ভালবাসতেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে ভূমিকম্পের জন্য বিল্ডিং কোড তৈরি করেন। ভূমিকম্প থেকে কিভাবে রক্ষা ডাওয়া যায় সেসবের জন্য কী একটা সোসাইটিও করেছিলেন। স্যরি, নাম এখন মনে পড়ছে না। একদিন বলেছিলেন, ‘ম্যাচের বাক্সের মতো দালান ওঠা শহরে ভয় নিয়ে আমরা আকাশের কাছাকাছি থাকি। এ শহরে ভূমিকম্প প্রতিরোধের ব্যবস্থা না মেনেই উঠছে দালান। কবে যে আমরা জীবনকে মূল্য দিতে শিখব!’
মারা যাওয়ার আগে জামিলুর রেজা চৌধুরী ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভিসি ছিলেন।
দেবদুলাল মুন্না
সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়