জার্মান কেন ফিলিস্তিন বিদ্বেষী- জাতীয় স্বার্থ নাকি ইহুদিপ্রীতি?

মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক

আসমা ইসলাম, আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-08 15:24:19

জার্মানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিটলার অসংখ্য ইহুদি নিধনের সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমান জার্মানকে সবসময়ই দেখা যায় ফিলিস্তিনিদের ঘোর বিরোধিতা করতে। এরা সবসময় ইসরায়েলের সমর্থনে কথা বলে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসরায়েল স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন দাবি তোলে। এর নেপথ্যে কারণ কী হতে পারে-জাতীয় স্বার্থ এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নাকি ইসরায়েল এবং ইহুদিপ্রীতি? 

২০২৩ এর ৭ অক্টোবরে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জার্মানি দৃঢ়ভাবে মিত্র ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায়। এমনকি গণহত্যার বিষয়ে আন্তজার্তিক মহলে ইসরায়েলের সমালোচনা ও সতর্কতা বৃদ্ধি পেলেও, জার্মান সরকার মিত্র সমর্থনে পিছ পা হয়নি। ১২ অক্টোবর দেশটির চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ ঘোষণা করেন জার্মানি শুধুমাত্র ইসরায়েলের পাশেই অবস্থান করবে, এ সমর্থন থেকে সরবে না। জার্মান সরকার ইসরায়েলি বাহিনীকে শুধু যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনই দিয়েছে তা নয়। বরং ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার সুবিধার্থে দ্রুত অস্ত্র রপ্তানিও করেছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে জার্মান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অবস্থান ছিল ঘোর বিরোধী। কঠোরভাবে তারা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের দাবির পুনরাবৃত্তি করে বারবার ফিলিস্তিন বিদ্বেষী মনোভাব তুলে ধরেছে দেশটি। ফিলিস্তিনে বিদ্যমান কয়েক দশকের এই বৈষম্য এবং জাতিগত নির্মূলকে উপেক্ষা করেই চলেছে জার্মানি। তোয়াক্কা করছে না আন্তর্জাতিক আইনেরও।

জার্মান রাজনৈতিক অভিজাতরা একসময়ের ইহুদি নিধনের অপরাধবোধের কথিত অনুভূতির কারণেই কি ইসরায়েলকে এতো সমর্থন করে? অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কী ইসরায়েলের অবস্থানকে ন্যায্যতা দিয়ে চলেছে? না, মূলত এসবের আড়ালে জার্মান রাজনীতিবিদ এবং কর্মকর্তারা আরব-বিরোধী এবং মুসলিম-বিরোধী মতবাদকে আরও স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। অভিবাসন-বিরোধী নীতিকে আরও কঠোরভাবে ন্যায্যতা দিতে চাইছেন। জার্মান-সেমিটিজমদের মধ্যকার বিরোধিতাকে কমিয়ে আনতে চাইছেন।

রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ফিলিস্তিনের বিরোধীতা

ফিলিস্তিনিদের প্রান্তিককরণ এবং ফিলিস্তিনিপন্থী সক্রিয়তাকে দমন করা জার্মানিতে নতুন কোনো ঘটনা নয়। ৭ অক্টোবরের অনেক আগে থেকেই, জার্মান কর্তৃপক্ষের ফিলিস্তিন-বিরোধী কৌশল বাড়তে থাকে। ফিলিস্তিনপন্থী কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য বহুবার বিদ্রোহীদের বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতেও দেশটিতে ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভ এবং পুলিশি সহিংসতার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন বেড়েছে। অসংখ্য বিক্ষোভ নিষিদ্ধও করা হয়েছে।

গাজায় ইসরাইল যুদ্ধ শুরু করার পর প্রথম সপ্তাহে কয়েকশ বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়। অনেকজনকে পুলিশি সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয় অতবা উস্কানি দেওয়ার অপরাধে তদন্তের আওতায় আনা হয়।

ফিলিস্তিনিপন্থী সক্রিয়তার ক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতাকেও দমন করা হয়েছে জার্মানে। সম্প্রতি, ফেডারেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’ স্লোগানটিকে ইসরায়েলকে ধ্বংস করার মন্ত্র বিবেচনায় করে নিষিদ্ধ করেছে। বাভারিয়া রাজ্য এই শব্দগুচ্ছটিকে ‘সন্ত্রাসবাদের প্রতীক’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

জার্মানির অন্যতম নেতৃস্থানীয় দল খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) স্পষ্ট করে বলে, জার্মানিতে ‘ফ্রী প্যালেস্টাইন’ শব্দের কোনও স্থান নেই। তাদের একমাত্র গণতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রের বিলুপ্তির চেতনা, যা জার্মান কখনও সমর্থন করেনা।

জার্মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও কোনো ফিলিস্তিনপন্থী মন্তব্য করা যায়না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সরকারের ইসরায়েলপন্থী অবস্থান অনুসরণ করতে হয়। এর ফলে বিক্ষোভকারী অনেক শিক্ষার্থী পুলিশি সহিংসতা এবং মিডিয়ার শ্লীলতাহানির শিকার হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান ফিলিস্তিনপন্থী প্রতীক, যেমন কেফিয়াহ স্কার্ফ নিষিদ্ধ করে। বার্লিনের একটি স্কুলে একজন শিক্ষক ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলনকারী এক ছাত্রকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছেন। ফিলিস্তিনপন্থী সক্রিয়তার এমন পদ্ধতিগত দমন জার্মানির ডাইস্টোপিয়ান-সদৃশ বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। গণহত্যার বিরোধিতা না করে অপরাধকেই বরং সমর্থন করে যাচ্ছে রাষ্ট্রটি।

জার্মান কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিন- বিরোধীতাকে জাতীয় স্বার্থ এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা সর্বান্তকরণে ইসরায়েলের অস্তিত্বকে সমর্থন করে। ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত সহিংসতা প্রয়োজন বলে মনে করে তারা। এটি অবশ্য জার্মানির নিজস্ব গণহত্যার ইতিহাস এবং ক্রমাগত বৈষম্যের ব্যতিক্রম নয়।

জার্মানে অভিবাসন কমানো এবং আরববিরোধী চিন্তার প্রসারের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল সমর্থন 

গাজার গণহত্যাকে ইস্যু করে ইতিমধ্যেই জেনোফোবিক এবং বর্ণবাদী অনুভূতিকে আরও শক্তিশালী করেছে জার্মান কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে মুসলিম ও আরবদেরকে জার্মান সমাজের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে তারা।

৮ নভেম্বর, জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেইনমায়ার ফিলিস্তিনি এবং আরব বংশোদ্ভূত জার্মান নাগরিকদের ইহুদি বিরোধীতা থেকে নিজেদের দূরে রাখার আহ্বান জানান। কারণ ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে জার্মান রাষ্ট্র একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসাবে মনোনীত করেছে।

এর এক সপ্তাহ পরে, জার্মান নাগরিকত্বকে ‘ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার’ এর আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতির সাথে আবদ্ধ করে জার্মান পার্লামেন্টে একটি খসড়া আইন পেশ করা হয়। এক মাস পরে, স্যাক্সনি-আনহাল্ট রাজ্য তার নিজস্ব মন্তব্য জারি করে বলেন, যারা এই রাজ্যের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবে তারা  ‘ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার’ এর জন্য সমর্থন করতে হবে। নভেম্বরে, ফেডারেল বিচারমন্ত্রী মার্কো বুশম্যান একটি সাক্ষাত্কারে বলেন ‘আমরা চাই না ইহুদি বিরোধীরা জার্মানের নাগরিক হোক।’

ফিলিস্তিনি অভিবাসীরা সন্ত্রাসের ঝুঁকি তৈরি করে। তারা  ইহুদি-বিদ্বেষ বহন করে এবং ছড়িয়ে দেয়। এমন দাবি তুলে জার্মান দেশটির অভিবাসন এবং শরণার্থীনীতি পরিবর্তন করার বিষয়টিকে ন্যায্য হিসাবে প্রচার করে। সিডিইউ নেতা ফ্রেডরিখ মার্জ বলেছেন, জার্মানি গাজা থেকে আর কোনো শরণার্থীদের স্থান দিতে পারবে না।

ইতিমধ্যেই অভিবাসন কমাতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে দেশটিতে। অক্টোবরে, ফেডারেল সরকার নির্বাসন নীতির অনুমতি দিয়ে একটি খসড়া আইন সমর্থন করে। এই আইন আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার ও আবেদন প্রত্যাহারকে আরও সহজ করে তুলবে।

গত এক দশকে আরব উদ্বাস্তুদের আগমনের কথা উল্লেখ করে দেশটির ডানপন্থী ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড’ সংবাদপত্রটি জার্মানিতে কী অনুমোদনযোগ্য বা কী গ্রহণযোগ্য নয় সে বিষয়ে ৫০ টি নির্দেশনা দিয়েছে।সেখানে বলা হয়, ইশতেহারে ইসলামোফোবিয়ার কথা আপাতভাবে বেশি। শ্বেতাঙ্গ জার্মানদের জন্য আরবরা হুমকির কারণ বলে জোর প্রচারণা তাদের। ফিলিস্তিনি জনগণ যখন তাদের নিজ দেশেই গণহত্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সে সময়ে এমন অযৌক্তিক ভাবনাকে প্রতিফলিত করছে দেশটি।

এমন কার্যকলাপ জার্মান সমাজে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যকেও উন্মোচিত করে। প্রকৃতপক্ষে, গাজায় যা ঘটছে তা নিয়ে জার্মান কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যায়, তারা জার্মান সমাজে বর্ণবাদী শ্রেণিবিন্যাসকে শক্তিশালী ও দৃঢ় করতে চায় যেখানে শীর্ষে শ্বেতাঙ্গ জার্মানদের এবং নিচে ইসরায়েলি সহিংসতার শিকারসহ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকরা থাকবে।

জার্মানির নৃশংস, ইহুদি-বিরোধী ইতিহাস ঢেকে রাখার নিমিত্তে ফিলিস্তিনের সমালোচনা

নৃশংস, ইহুদি-বিরোধী ইতিহাসকে অস্পষ্ট করার জন্য এবং বিশ্বের কাছে তাদের ইহুদিপ্রীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেও ক্রমাগত ফিলিস্তিনবিরোধী অবস্থানে থাকছে জার্মান। ইহুদিদের দুর্ভোগের জন্য যেন জার্মানের উপর থেকে নজর সরে যায় বিশ্বের। তারা ফিলিস্তিনিদের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ইউরোপীয় বর্ণবাদী, সেটলার-ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসকে ঢেকে দিতে চায়।

এরকম ইসরায়েল সমর্থন বর্তমানের ইহুদি-বিরোধী চেতনাকেও ঢেকে রাখে। ইহুদি বিরোধী মনোভাব এখনও জার্মানিতে টিকে আছে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, নথিভুক্ত বেশিরভাগ ইহুদি-বিরোধী ঘটনা সংঘটিত হয় এখানে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পরিচালিত জরিপ অনুসারে, এখানে ইহুদি-বিরোধী ঘটনার হার বর্তমানে ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

জায়নবাদ এবং বিষাক্ত জার্মান জাতীয়তাবাদের এই সংমিশ্রণটি ইহুদি সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী সহিংসতাকে আরও ইন্ধন দিতে পারে। জার্মানির ফিলিস্তিন বিরোধীতাকে ইসরায়েলের সাথে হওয়া অপরাধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়, বরং জার্মানির ধারাবাহিক আচরণ হিসেবে দেখা উচিত। ফিলিস্তিনকে মোড়ক করে বিশ্বের কাছে নিজেদের ইহুদি-বন্ধু হিসেবে পরিচিত হতে মরিয়া জার্মান বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিক সুবিধার জন্য এমনটা করছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। তবে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল দ্বন্দ্ব সমাধানে জার্মানকে এমন মতাদর্শ থেকে অবশ্যই সরে আসা উচিত।

সূত্র: আল জাজিরা  

এ সম্পর্কিত আরও খবর