আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালের তিন দিন পার হলেও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে কারো নাম ঘোষণা করতে পারেনি। মূলত নেতৃত্ব জটিলতার কারণে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও তার মৃত্যুর পরের দিনই হাটহাজারী মাদারাসা কর্তৃপক্ষ মাদরাসা পরিচালনা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে।
হেফাজত তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে বিলম্ব করছে কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর সরাসরি কেউ দিতে চাননি। তবে ঢাকার এক আলেম বলেন, ‘নানা কারণে হেফাজতে ইসলাম নিয়ে ঢাকার আলেমদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। সাংগঠনিকভাবে হেফাজতের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এ কারণেই মূলত সংগঠনটির প্রধান নিয়ে ঢাকার আলেমদের মধ্যে আগ্রহ কম।’
আল্লামা শফী চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম ছাড়া আরও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এবং আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রবীণ এই আলেমের মৃত্যুর পর এখন কে বা কারা আসছেন হেফাজতে ইসলাম, বেফাক ও হাইআয় নেতৃত্বে সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি। এটা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা। চট্টগ্রাম নাকি ঢাকা থেকে হেফাজতের আমির নির্বাচিত হবেন- তা নিয়েও সংগঠনের ভেতরে চলছে বিস্তর জল্পনা।
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি ঘরানার বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। তখন এর আমির মনোনীত হন আল্লামা শফী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ২০১১ সালে তার নেতৃত্বে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’র বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে এবং ঢাকায় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে আন্দোলন হয়। ২০১২ সালে এই দুই নেতার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে ঢাকার আলেমদের মধ্যে এক ধরনের নেতৃত্বহীনতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে হেফাজতের ব্যানারে আল্লামা শফী কওমি ঘরানার সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলকে এক ব্যানারে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ‘নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি এবং ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসহ ব্লাসফেমি আইন করার দাবিতে অনুষ্ঠিত লংমার্চ এসে রাজধানীর শাপলা চত্বরে জমায়েত হওয়ার পর ওই প্রথম হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী নজর কেড়ে নেয়। এরপর থেকেই তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলে খবরের শিরোনাম হন।
আরও পড়ুন: হেফাজত, খতমে নবুয়ত ও বেফাকে পৃথক নেতৃত্ব!
আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের আমির হিসেবে যাদের নাম আলোচনায় আসছে তারা হলেন- বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, সহ-সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী ও বর্তমান মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।
হেফাজত ইসলামের পরবর্তী আমির কে হবেন এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘হেফাজত ইসলামের পরবর্তী আমির কে হবেন এটা আল্লাহতায়ালা জানেন। তবে আমরা চেষ্টা করব উনার (আল্লামা শফী) আদর্শ বাস্তবায়ন করার। সেটা হাটহাজারী মাদরাসা ও হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারেও। আল্লামা শাহ আহমদ শফির মতো মানুষ আর পাওয়া যাবে না। এখন আমার দায়িত্ব হলো- কাউন্সিল ডাকা। কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত হবে।’
হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কাউন্সিলে সংগঠনের বর্তমান মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচিত হতে পারেন- সাদামাটাভাবে এমনটি ভাবা হলেও, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আল্লামা বাবুনগরী এ বিষয়ে আগ্রহী নন। প্রথমত তিনি হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষাসচিব ও প্রধান শায়খুল হাদিস নির্বাচিত হয়েছেন, এ জন্য তার ব্যস্ততা ও দায়িত্ব বেড়েছে। অন্যদিকে তিনি যে কখনও হেফাজতের আমির হতে চাননি কিংবা এটা নিয়ে আল্লামা শফীর সঙ্গে তার কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না- এটার প্রমাণ দিতে চান। সেক্ষেত্রে হেফাজতের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হেফাজতের আমির নির্বাচিত হতে পারেন। চট্টগ্রামে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।’
এদিকে ঢাকা মহানগর হেফাজতের সভাপতি বারিধারা মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমি বলেছেন, ‘হেফাজতের নেতৃত্ব নির্বাচন হবে কাউন্সিলের মাধ্যমে। যথাসমযে সংগঠনের মহাসচিব কাউন্সিল আহ্বান করবেন।’
তবে সংগঠনের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মইনুদ্দিন রুহী এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে গণমাধ্যমে মত দিয়েছেন। তার বক্তব্য হলো, ‘কাউন্সিলের নামে লোক দেখানো ‘নাটক’ হবে। নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে, যা অনৈতিক।’
হেফাজত নেতাদের অনেকে মনে করেন, হাটহাজারী মাদরাসার নতুন প্রধান পরিচালক যিনি হবেন তিনিই পদাধিকার বলে হেফাজতের আমির হবেন। কিন্তু আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর মাদরাসার শুরা কমিটি একক কাউকে মাদরাসার পরিচালক বানাননি। তিন জনের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটির প্রধান হলেন, মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী। তিনি হেফাজতের নেতৃত্বে আসবেন কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে আল্লামা শফী মাদারাসার শুরা কমিটির বৈঠকে বেশ কিছুদিন আগে হেফাজতের নতুন আমির হিসেবে আল্লামা শেখ আহমদের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু শুরা সদস্যরা বিষয়টি এড়িয়ে যান। তাদের যুক্তি ছিলো, এটা মাদারাসার মিটিং, এখানে হেফাজতের নেতা নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। সেই শেখ আহমদও রয়েছেন মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে। তাকেও হেফাজতের আমির হিসেবে দেখা যেতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, ‘হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে কিছুটা জটিলতা রয়েছে। কারণ হেফাজতের অনুমোদিত কোনো গঠনতন্ত্র নেই। তবে শুরা ও নির্বাহী কমিটি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজমান। তাই সাংগঠনিক কমিটির সভায় এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মতবিরোধ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদের বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা কাউন্সিলে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া যেতে পারে।’
পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা স্পষ্ট যে, হেফাজতের আমির নির্বাচন নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা দ্বন্দ্বে জড়াতে পারেন। কারণ, আল্লামা শফীর জীবনের শেষ কয়েকটি দিন খুব ভালো যায়নি। অনেকে এটাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং নতুন আমির নির্বাচনের তাদের বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হবে, এটা নিশ্চিত।
ঢাকা মহানগর হেফাজতের এক সিনিয়র নেতার মতে, ‘সহ-সভাপতিদের মধ্য থেকে যে কেউ হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। পরবর্তী সময়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। সে হিসেবে ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে নায়েবে আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী ও মুফতি ওয়াক্কাসের নাম রয়েছে আলোচনার শীর্ষে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজত নেতাদের কোন্দল-গ্রুপিংয়ের কারণে ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে জরুরি কাউন্সিলও করতে পারে সংগঠনটি। কাউন্সিলে সংগঠনের বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী নতুন আমির নির্বাচিত হতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকেই। আর আল্লামা বাবুনগরী আমির হলে, মহাসচিব হিসেবে প্রায় সবাই বিনাবাক্যে আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমীকে পছন্দের তালিকায় রাখছেন। কারণ, ঢাকাকেন্দ্রিক হেফাজতের যাবতীয় কর্মসূচী তার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। ঢাকাসহ সারাদেশের আলেম-উলমাদের মাঝে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। হেফাজতের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ধারণা, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী মহাসচিব হলে হেফাজতের কার্যক্রম নতুন করে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী হবে। হেফাজত তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
মহাসচিব হিসেবে আরও আলোচনায় রয়েছে মাখযানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদীর নাম। তিনি চট্টগ্রামের সন্তান ও কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখ। তার সাংগঠনিক দক্ষতা পরীক্ষিত।
তবে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর প্রচার সেলের সদস্য মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘হেফাজতের কমিটিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় জরুরি। তাতে সংগঠনে গতি পাবে।’ তার মতে, ‘তরুণ প্রজন্ম হেফাজতের মহাসচিব হিসেবে মাওলানা মামুনুল হককে চান। পারিবারিক অবস্থান, হেফাজতের আন্দোলনের দরুণ কারাবরণ তাকে তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলেছে। মাঠে-ময়দানে সরব এই নেতা।’ সুতরাং আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আমির নির্বাচিত হলে, মাওলানা মামুন মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন।
প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা না থাকলেও এটা স্পষ্ট যে, দুই ভাগে বিভক্ত হেফাজতে ইসলাম। এক গ্রুপ আল্লামা শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর নেতৃত্বে হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা মইনুদ্দিন রুহিরা রয়েছেন। যদিও মাওলানা আনাসের হাটহাজারী থেকে বহিষ্কারের ঘটনা এই গ্রুপকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। তারা এখন অনেকটাই আলোচনার বাইরে।
অন্য গ্রুপের রয়েছেন হেফাজতের বর্তমান মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, সাবেক মন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামিদ, মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকসহ কওমি ঘরানার অধিকাংশ আলেম-উলামা ও হেফাজতের নেতা-কর্মী।
অবশ্য উভয়পক্ষই হেফাজতে কোনো গ্রুপিং আছে বলে মানতে নারাজ।
আগামী পর্বে: গতিহীন বেফাকের নতুন কাণ্ডারির খোঁজে