হেফাজত, খতমে নবুওয়ত ও বেফাকে পৃথক নেতৃত্ব!
শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর কে হচ্ছেন তার উত্তরসূরি? একক কারো নেতৃত্ব তার শূন্যতা পূরণ করবে, না যৌথ কিংবা পৃথক নেতৃত্ব দেখা যাবে- বিষয়টি নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ ইসলামি রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা ও বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু না হলেও ঘরোয়াভাবে আলোচনা হচ্ছে। তার স্মরণে আয়োজিত আলোচনা ও দোয়া মাহফিলে একদিকে যেমন এসব বিষয় উঠে আসবে, তেমনি বুঝা যাবে নেতৃত্বে পাল্লা কোন দিকে ভারি হচ্ছে।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) আল্লামা শফীকে চির বিদায় জানাতে আসা শোকার্ত মানুষের মুখেও তার শূন্যতা পূরণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই দিন সন্ধ্যায় হাটহাজারী মাদরাসা পরিচালনায় একক কাউকে নির্ধারণ না করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠনের মাধ্যমে বুঝা যায়, আল্লামা শফীর উত্তরসূরি এককভাবে কেউ হচ্ছেন না।
কারণ, একক নেতৃত্ব নিয়ে সৃষ্ট নানাবিধ ঝামেলার কারণে ইন্তেকালের মাত্র ২০ ঘণ্টা আগে মাদরাসার মুহতামিম পদ থেকে সরে দাঁড়ান আল্লামা শফী। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে মাদরাসার শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষা পরিচালক আল্লামা শফীর পুত্র আনাস মাদানীকেও বহিষ্কার করা হয়।
আল্লামা শফীর সততা, ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে শতবর্ষী আল্লামা শফী নানা অসুখ-বিসুখে দুর্বল হয়ে পড়লে মাওলানা আনাসকে কেন্দ্র করে একটি চক্র গড়ে উঠে। দীর্ঘদিন ধরে ওই গোষ্ঠীটি তাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে, নানা সময়ে তারাই আল্লামা শফীর হয়ে তার বক্তব্য-বিবৃতি তৈরি করে প্রচার করেছে। বেফাকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, হেফাজতে নেতৃত্ব দেওয়াসহ মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা দেখা নানাভাবে। এই বিতর্কের মধ্যেই আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কাছ থেকে হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী পরিচালকের পদ কেড়ে নিয়ে সেখানে পদায়ন করা হয় আল্লামা শেখ আহমদকে।
এরপর থেকে মাওলানা আনাস এককভাবে মাদরাসায় কর্তৃত্ব শুরু করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুতও করেন মাওলানা আনাস। মাওলানা আনাসের এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলনে তাকে বহিষ্কারের দাবি তোলা হয়। এ দাবির প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত তাকে স্থায়ীভাবে সহকারী শিক্ষা পরিচালকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্র বিক্ষোভের অবসান না হতেই চিরবিদায় নিলেন আল্লামা শফী। তার ইন্তেকালে এখনও শোকসাগরে ভাসছে হাটহাজারী মাদরাসা। ইতোমধ্যে হাটহাজারী মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তিন সদস্যের একটি কমিটিকে। তারা হলেন- মাদরাসার ফতোয়া ও আইন বিভাগের প্রধান মুফতি আবদুস সালাম, সহকারী পরিচালক মাওলানা শেখ আহমদ ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা ইয়াহহিয়া।
হাটহাজারী মাদরাসায় যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে আলোচনা হচ্ছে, কে হচ্ছেন অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কাণ্ডারী? আর বেফাক চেয়ারম্যানের পদে কাকে দেখা যাবে। এসব স্থানে একক কেউ আসবেন না ভিন্ন ভিন্ন কেউ?
হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশর আমির ছাড়াও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) ও আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সর্বশেষ চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনে ইতিপূর্বে গঠিত খতমে নবুওয়ত আন্দোলন সম্পর্কিত সব সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ’ নামে আল্লামা শফীর নেতৃত্বে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। সে হিসেবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক), আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া ও আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের নেতৃত্বে কে বা কারা আসবেন এটা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা, আলোচনা ও বিশ্লেষণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতদিন এসব এককেন্দ্রিক থাকলেও এখন তিনটি সংগঠনই আলাদাভাবে পরিচালিত হবে। কারণ আল্লামা শফীর মতো সর্বজনমান্য এমন কেউ নেই, যাকে সবাই একবাক্যে মেনে নেবেন। আল্লামা শফী এমন সময় কওমি অঙ্গনের হাল ধরেছিলেন, যখন পারস্পরিক অনৈক্য, অনাস্থা ও বিভেদের জেরে ইসলামি অঙ্গনে নেতৃত্বহীনতা দেখা দিয়েছিল। ধর্মীয় নানা বিষয়ে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। এমতাবস্থায় তিনি মাঠে এসে আলেম-উলামা থেকে শুরু করে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসেন। তার নেতৃত্বে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবি বাস্তবায়িত হয়।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হেফাজতসহ বেফাকের নেতৃত্বে অভিজ্ঞ, দূরদর্শী এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষমদের আসা উচিত। বেফাকের কর্মকাণ্ডের স্থবিরতা, হেফাজতে ইসলামের হোঁচট খাওয়া এবং তৎপরতা থমকে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের প্রভাব, সক্ষমতা, সংগঠনটির উপযোগিতা ও আবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠালেও নেতৃত্ব নির্বাচনে তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থীরভাবে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
২০০৫ সালে বেফাকের সভাপতি নির্বাচিত হন আল্লামা আহমদ শফী। ২০১৭ সালে নির্বাচিত হন আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান। গঠনতান্ত্রিকভাবে বেফাকের চেয়ারম্যান যিনি হবেন তিনিই আল হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান হওয়ার কথা।
আর খতমে নবুওয়ত আন্দোলন সম্পর্কিত সব সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ’ নামে সংগঠন পরিচালনা করার কথা থাকলেও বিদ্যমান সংগঠনগুলোর নেতারা এটা নিয়ে তখনই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সুতরাং খতমে নবুওয়ত সম্পর্কিত সংগঠনগুলোও আগের ধারায় যে চলবে এটাও বলা চলে নিশ্চিতভাবে।
বস্তুত ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে আল্লামা শফী এককভাবে এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মতো বিতর্কহীন নেতৃত্ব এই মুহূর্তে নেই। তাছাড়া বেফাক আর হাইআর চেয়ারম্যান পদটি খুবই গুরুত্বের দাবি রাখে। তাই এ পদে এমন কাউকে বসাতে হবে, যার কোনো রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ নেই, সেই সঙ্গে তিনি থাকবেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সে হিসেবে হেফাজতে ইসলামের লক্ষ্য, কর্মসূচি আর বেফাক-হাইআর কর্মসূচিতের বিস্তর ফারাক রয়েছে। সঙ্গত কারণেই এসব স্থানে ভিন্ন নেতৃত্ব দরকার। আল্লামা শফীর অবর্তমানে আলেমদের আলোচনায় এ বিষয়গুলোই উঠে আসছে।