দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরকে বলা হয় বহু সংস্কৃতির দেশ। ধনী দেশ সিঙ্গাপুরের প্রথম মুসলিম নারী প্রেসিডেন্ট হলেন হালিমা ইয়াকুব। তিনি দেশটির অষ্টম এবং প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। পুরো সিঙ্গাপুরে ৭০টির মতো মসজিদ রয়েছে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা-দীক্ষাসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে মুসলমানদের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে।
সিঙ্গাপুরে ধর্ম নিয়ে কারও ততটা মাথাব্যাথা নেই বলা চলে। দেশটিতে ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা রয়েছে। তার পরও সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে শুরু হয়েছে ‘হিজাব’ নিয়ে বিতর্ক। বিষয় ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর পর্যায়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
যদিও মুসলিম নারীদের কর্মক্ষেত্রে হিজাব পরার বিষয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্বের অনেক দেশেই। কিন্তু সিঙ্গাপুরে এই বিষয়ে বিতর্ক একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তবে সিঙ্গাপুরে হিজাব নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি নতুন নয়।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সৃষ্ট লকডাউন শিথিল হওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে একটি খাবারের দোকানের মহিলাকর্মীকে হিজাব খুলে ফেলতে বলেছিল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি প্রকাশ পেলে আরও অনেক মুসলিম নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে থাকেন। তখনই দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয় হিজাব নিয়ে।
এমতাবস্থায় দেশটির প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব বলেন, ‘হিজাবের বিষয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের কোনো সুযোগ তিনি দেখেন না।’
ডিপার্টমেন্ট স্টোরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য যে কাউকে উপার্জন থেকে বঞ্চিত করে।’
হালিমা তার ফেসবুকে আরও লিখেন, ‘লোকদের কেবল তাদের যোগ্যতা এবং কোনো কাজ করার দক্ষতা এবং অন্য বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা উচিত। ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়।’
‘এই কোভিড -১৯ সময়কালে যখন চাকরি ও জীবিকা নির্বাহের বিষয়ে সবাই উদ্বিগ্ন, তখন বৈষম্যের এমন ঘটনা উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং মানুষে জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়,’ বলে তিনি যোগ করেন।
উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের প্রথম মুসলিম নারী প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব নিয়মিত হিজাব পরিধান করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংসদের স্পীকারের দায়িত্বও সামাল দিয়েছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে।
একই কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং। তিনি বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য বিরক্তিকর। এমন আচরণ মানুষের রুটিরুজির ওপর প্রভাব ফেলে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
চল্লিশ লাখ লোকের দেশ সিঙ্গাপুরে শতকরা ১৫ ভাগ মুসলিম। পুলিশ বিভাগসহ দেশটির বেশ কিছু কর্মক্ষেত্রে নারীদের হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সম্প্রতি এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ‘আপিল আন্দোলন’ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার লোক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে স্বাক্ষর করেছেন।
অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ। অনেক মুসলিম নারী সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কিন্তু অফিসে আসা-যাওয়ার সময় হিজাব পরিধান নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। ডিউটি শুরু আগে তারা হিজাব খুলে ফেলেন। এটা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে কথা শুরু হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে কর্মক্ষেত্রে হিজাব নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নারী উন্নয়নে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন দেশটিতে মুসলিম নারীদের উন্নয়নে কাজ করা কর্মীরা। তারা বলছেন, ‘মুসলিম নারীদের জন্য এই ধরনের বিধি-নিষেধ চাকরির সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষত করোনভাইরাস মহামারি সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লোক ছাঁটাই করছে। এই সময়ে এমন বিতর্ক সামনে আনার অর্থই হলো, নির্দিষ্ট শ্রেণির লোকদের ছাঁটাইয়ের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো।’
সামিয়া সুমানো নামের এক মুসলিম নারী বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এক ওয়েবসাইটে তার মতামত তুলে ধরেন এভাবে, ‘চাকরির সঙ্গে ধর্মের অনুশীলনকে না মেলানোই ভালো। চাকরির জন্য প্রয়োজন যোগ্যতা, এই যোগ্যতাকে ধর্মীয় কারণে নাকচ করা ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেয়।’ তিনি মুসলিম নারীদের স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মচর্চা করতে দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে এই সমস্যাটি কেবলমাত্র মুসলিম নারীদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে, এটি মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে একটি শক্ত বৈষম্যমূলক নীতি।’
তার মতে, ‘শিখ পুরুষরা যদি পাগড়ি মাথায় সিঙ্গাপুরে কাজ করার অনুমতি পায়, তাহলে মুসলিম নারীদের প্রতি এই অন্যায় মেনে নেওয়া কঠিন।’
‘নিষেধাজ্ঞার ফলে নারীরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। এটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল অন্তরায়’ বলেও মত দেন তিনি।