দুশ্চিন্তা একটি স্বাভাবিক বিষয়। সবার ক্ষেত্রেই কমবেশি এ সমস্যা দেখা দেয়। তবে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে তখনই যখন কেউ সামান্য কারণেই চিন্তাগ্রস্ত হয় পড়ে।
কেন এমনটি হয়? এর উত্তরে মনোবিদরা বলেন, ‘স্ট্রেস কিংবা দুশ্চিন্তা আসলে দুই ধরনের হয়। শর্ট বা মৃদু ধরনের এবং লং বা তীব্র। মৃদু দুশ্চিন্তা অনেক সময় তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। মানুষের শরীরে কারটিসল নামে এক ধরনের হরমোন রয়েছে। এ হরমোনের পরিমাণ যত বাড়বে দুশ্চিন্তার পরিমাণও তত বাড়বে। সাধারণত একাকিত্ব, পারিবারিক সমস্যা, সব ক্ষেত্রে সফল হওয়ার অভিপ্রায় এবং জিনগত কারণে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হয়ে থাকে।
প্রবাদ আছে, ‘একবেলা আহার না পেলে মানুষ যতটা ভেঙে পড়ে তার চেয়ে দ্বিগুণ ভেঙে পড়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে।’ মানসিক সমস্যা তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দেয়। দুশ্চিন্তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের মস্তিষ্ক। ফলে স্মৃতিভ্রষ্টতা, বুদ্ধিবৈকল্য দেখা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় হার্ট। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, ক্ষুধা, নিদ্রাহীনতা এমনকি বহুমূত্র রোগের অন্যতম উপসর্গ হলো- মানসিক চাপ।
দুশ্চিন্তার কারণে মনের ওপর প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। খিটমিটে মেজাজ, অল্পতেই বিষণ্ন হওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া, অভিমান ও হতাশার মতো অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে শুধু দুশ্চিন্তার কারণে।
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার এত যখন সমস্যা, তাহলে শুধু শুধু কেন নিজের ক্ষতি করা? আজই ঝেড়ে ফেলুন যত মানসিক চাপ। দুশ্চিন্তা কমাতে ইসলামি চিন্তাবিদরা বেশ কিছু আমলের কথা বলে থাকেন। এগুলো নিয়মিত মেনে চললে দুশ্চিন্তা থেকে মিলবে মুক্তি। আমলগুলো হলো-
১. ভালো-মন্দ তাকদিরের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখুন। কেননা তাকদিরের ওপর পূর্ণ আস্থাবান ব্যক্তিকে দুশ্চিন্তা কাবু করতে পারে না। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তার অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই...।’ –সূরা ইউনুস: ১০৭
২. দুনিয়ার বিপদের তুলনায় পরকালের বিপদের কথা স্মরণ করুন। দুনিয়ার বিপদ-আপদ আপনার জন্য পরকালের বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার কারণ হতে পারে। আর পরকালের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির তুলনায় দুনিয়ার বিপদ-আপদ খুবই নগণ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে।’ –সূরা নাজিয়াত: ৪৬
৩. চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিন। নিজের চেয়ে নিচের মানুষদের অবস্থার দিকে তাকান। ভাবুন, আল্লাহ আপনাকে তার থেকে ভালো রেখেছেন। মনোবিজ্ঞানীরাও ডিপ্রেশনের চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে এভাবে চিন্তা করার উপদেশ দিয়ে থাকেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেড় হাজার বছর আগেই চিকিৎসার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। হাদিসে এসেছে, হজরত খাব্বাব (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করলাম এ অবস্থায় যে তিনি কাবাঘরের ছায়ায় একটি চাদরে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করবেন না? জবাবে তিনি বলেন, ‘তোমাদের জানা উচিত, তোমাদের আগের মুমিন লোকেদের এই অবস্থা ছিল যে একজন মানুষকে ধরে আনা হতো, তার জন্য গর্ত খুঁড়ে তাকে তার মধ্যে পুঁতে রাখা হতো। অতঃপর তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে তাকে দুই খণ্ড করে দেওয়া হতো এবং দেহের গোশতের নিচে হাড় পর্যন্ত লোহার চিরুনি চালিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু এই কঠোর পরীক্ষা তাকে তার দ্বীন থেকে ফেরাতে পারত না।’ –সহিহ বোখারি: ৩৬১৬
৪. আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করুন। তার ওপর ভরসা রাখুন। আশা রাখুন যে, তিনি আপনাকে আপনার দুরবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ –সূরা তালাক: ৩
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ –সহিহ বোখারি: ৬৯০১
৫. ধৈর্য ধারণ করুন। বিশ্বাস করুন যে কষ্টের পর স্বাচ্ছন্দ্য আসে। কঠিন অবস্থার পর স্বচ্ছলতা আসে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘...নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ –সূরা বাকারা: ১৫৩
৬. সালাতুল হাজাত পড়ুন। হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন দুশ্চিন্তায় পড়তেন, নামাজে মগ্ন হতেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও...।’ –সূরা বাকারা: ১৫৩
৭. বেশি বেশি ইস্তেগফার করুন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি তো মহাক্ষমাশীল। (ফলে) তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে।’ –সূরা নুহ: ৭১
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ –সুনানে আবু দাউদ: ১৫২০
৮. অধিকহারে দরুদ পড়ুন। হাদিসে এসেছে, হজরত উবাই ইবন কাব (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার ওপর অধিকহারে দরুদ পাঠ করে থাকি। আমার সময়ের কতটুকু আপনার প্রতি দরুদ পাঠে ব্যয় করব? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। আমি বললাম, এক-চতুর্থাংশ সময়? তিনি বলেন, তোমার ইচ্ছা। কিন্তু যদি আরও বাড়াও তবে ভালো। আমি বললাম, অর্ধেক সময়? তিনি বলেন, তোমার যা ইচ্ছা; তবে আরও বৃদ্ধি করলে তাও ভালো। আমি বললাম, দুই-তৃতীয়াংশ সময়? তিনি বলেন, তোমার ইচ্ছা; তবে আরও বাড়ালে তাও ভালো। আমি বললাম, আমার সবটুকু সময় আপনার ওপর দরুদ পাঠে লাগাব? তিনি বলেন, তাহলে তো তোমার চিন্তামুক্তির জন্য তা যথেষ্ট হয়ে যাবে আর তোমার গোনাহ মাফ করা হবে। -সুনানে তিরমিজি: ২৪৫৭
৯. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। নির্ভরযোগ্য আলেমের সঙ্গে অভিমত গ্রহণ করুন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি পরামর্শ কামনা করে সে অকৃতকার্য হয় না।’ -ইবনে হিব্বান: ৭৬৮
১০. দুশ্চিন্তা ও মানসিক অস্থিরতা থেকে নাজাতের উদ্দেশ্যে হাদিসে বেশ কিছু দোয়া শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ওই দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়ুন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি এমন একটি দোয়া সম্পর্কে অবগত আছি, কোনো বিপদগ্রস্ত লোক তা পাঠ করলে আল্লাহতায়ালা তার সেই বিপদ দূর করে দেন। সেটি হচ্ছে, আমার ভাই ইউনুস (আ.)-এর দোয়া। দোয়াটি হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বলিমীন।’
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত। -সুনানে তিরমিজি: ৩৫০৫
চিন্তা ও পেরেশানির সময় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি বিশেষ দোয়া পড়তেন। দোয়াটি হলো- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউজু বিকা মিনাল আজযি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউজু বিকা মিন দ্বালায়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে।
হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) চিন্তাযুক্ত অবস্থায় এই দোয়া পড়তেন। -সহিহ বোখারি: ২৮৯৩