এমন কিছু আমল রয়েছে, যে আমলে আল্লাহতায়ালা বেশি খুশি হন এবং পরকালে মুক্তি মেলে; তা হলো- আল্লাহতায়ালার কাছে স্বীয় পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও তওবা করা। ক্ষমা চাওয়াকে বলা হয় ইসতিগফার, তা হয় মৌখিকভাবে আর তওবা হয় মনে মনে।
তওবা অর্থ ফিরে আসা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় তওবা বলা হয়, অতীতের অপকর্মের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে এ কাজ না করা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বেশি বেশি ইসতিগফার ও তওবা করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তওবা করি।’ –সহিহ বোখারি: ২৩২৩
অন্যত্র ইরশাত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। আমি আল্লাহর কাছে দৈনিক ১০০ বার তওবা করি।’ -সহিহ মুসলিম
ক্ষমা প্রাপ্তির আশা করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলদের মধ্যে এক ব্যক্তি ৯৯ জন লোককে হত্যা করে। অতঃপর তার মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয়। ফলে সে ক্ষমা পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না তা জানার জন্য একজন পাদ্রিকে জিজ্ঞেস করে, তার এ পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না? পাদ্রি বলে- না, কোনো সুযোগ নেই। অতঃপর সে রাগ হয়ে তাকেও হত্যা করে। হত্যাকারী পুনরায় মানুষদের জিজ্ঞেস করে, তার মাফ পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না? এক ব্যক্তি বললেন- হ্যাঁ, সুযোগ আছে। তুমি অমুক গ্রামে যাও, তাদের সঙ্গে গিয়ে সঙ্গ দাও। সে ক্ষমা পাওয়ার প্রবল আশায় সেই গ্রামের দিকে রওনা হলো। অতঃপর তার হায়াত শেষ হয়ে যায়। ফলে তার রূহ নেওয়ার জন্য দু’জন ফেরেশতা আসেন। একজন রহমতের ফেরেশতা, অপরজন আজাবের ফেরেশতা। উভয়ে তার রূহ নেওয়ার জন্য বিতর্ক করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহতায়ালা তাদের কাছে এ মর্মে অহি পাঠালেন যে, তার রাস্তা পরিমাপ করো। বাড়ি থেকে ওই ব্যক্তির কাছে আসার রাস্তা বেশি কাছে, না-কি ক্ষমার দিকে যাওয়ার রাস্তা বেশি কাছে। অতঃপর দেখা গেল- তার ক্ষমা প্রাপ্তির আশায় গমনের রাস্তা এক বিগত কাছে। অতঃপর রহমতের ফেরেশতা তার রূহ নিয়ে যাবেন এবং আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন।’ –সহিহ মুসলিম: ২৩২৭
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের দুই ব্যক্তির মাঝে খুবই বন্ধুত্ব ছিল। একজন ছিল অধিক ইবাদতকারী, আর অন্যজন ছিল পাপি। একদা ইবাদতকারী বন্ধু তার পাপি বন্ধুকে বলল, হে বন্ধু! তুমি পাপাচার ছাড়ো। পাপি বন্ধু বলল, তুমি আমাকে আমার অবস্থায় ছেড়ে দাও। আমার প্রভু অতি মেহেরবান ও দয়ালু, তিনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। একদিন আবেদ বন্ধু পাপি বন্ধুকে মারাত্মক গোনাহ করতে দেখে বলল, তুমি পাপাচার বর্জন করো। পাপি বন্ধু বলল, আমাকে আমার পথে ছেড়ে দাও, আমার প্রভু আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। তোমাকে কী আমার ওপর প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে? তখন আবেদ বন্ধু রেগে গিয়ে বলেন, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তোমাকে আদৌ ক্ষমা করবেন না এবং তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। অতঃপর আল্লাহতায়ালা তাদের কাছে একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা তাদের রূহ কবজ করে আল্লাহর দরবারে হাজির করেন। আল্লাহতায়ালা তখন পাপিকে বলেন, আমি দয়া করে তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব, আর আবেদকে বলেন, আমি আমার বান্দার প্রতি যে দয়া করলাম তুমি কি তা দূর করার সামর্থ্য রাখো। আবেদ বললো, না; হে প্রভু! আল্লাহতায়ালা বললেন, একে জাহান্নামে নিয়ে চলো।’ –মিশকাত: ২৩৪৭
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর ব্যাপারে ভালো ধারণা তথা তিনি তার প্রতি দয়া করবেন অথবা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এ ধারণা পোষণ করা ছাড়া মৃত্যুবরণ না করে।’ –সহিহ মুসলিম: ২৮৭৭
আল্লাহতায়ালা বড়ই ক্ষমাশীল
হজরত আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শয়তান আল্লাহর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে বলেছে, হে প্রভু! আপনার সম্মানের শপথ করে বলছি, আপনার বান্দার দেহে রূহ থাকা পর্যন্ত আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব। আল্লাহতায়ালা শয়তানের জবাবে বলেন, আমার ইজ্জত, উচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের শপথ করে বলছি, আমিও তাদেরকে ক্ষমা করতে থাকব, যখনই আমার কাছে ক্ষমা চায়।’ –মিশকাত: ২৩৪৪
নবী করিম (সা.) আরও বলেন, ‘ওই জাতের শপথ! যার হাতে আমার জীবন। যদি তোমরা গোনাহ না করতে আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে ধ্বংস করে এমন জাতি আনয়ন করতেন, যারা গোনাহ করে তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত। অতঃপর তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।’ –মিশকাত: ২৩২৮
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘আল্লাহর রয়েছে ১০০ ভাগ দয়া-মায়া। তন্মধ্যে এক ভাগ মানব, দানব, পশু, পাখি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদির মধ্যে বিতরণ করেছেন। এক ভাগ দয়া-মায়া পেয়ে তারা তাদের সন্তানকে এত স্নেহ মহব্বত করে। আর ৯৯ ভাগ দয়া-মায়া আল্লাহতায়ালা নিজের কাছে রেখেছেন, বিচার দিবসে তার বান্দাকে দয়া করার জন্য।’ –মিশকাত: ২৩৬৫
ক্ষমা চাইলে ও তওবা করলে আল্লাহ খুশি হন
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তওবা করলে আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তির চেয়ে বেশি খুশি হন যে ব্যক্তি মরুভূমিতে তার বাহন নিয়ে ভ্রমণ করেছে। তাতে তার খাদ্য ও পানীয় রয়েছে, অতঃপর সে পথিমধ্যে নিদ্রা গেছে। অতঃপর বাহনটি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। অতঃপর নিরুপায় হয়ে একটি গাছের ছায়ায় নিদ্রা গেছে। নিদ্রা থেকে জেগে উঠে দেখে তার বাহনটি উপস্থিত। তখন সে অতি খুশিতে বলে ফেলেছে- হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা, আর আমি আপনার রব।’ –সহিহ মুসলিম
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন যখন গোনাহ করে তখন তার কলবে একটি কাল দাগ পড়ে যায়। যদি সে তওবা ও ইসতিগফার করে, তবে কলব পরিষ্কার হয়ে যায়।’ -ইবনে মাজাহ
জীবিত ব্যক্তিদের ইসতিগফারের কারণে কবরবাসীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা জান্নাতে নেক বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন। বান্দা তখন আশ্চর্য হয়ে বলবে, হে প্রভু! আমার হঠাৎ এ মর্যাদা কেন হলো? তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, এ মর্যাদা তোমার সন্তানের ইসতিগফারের কারণে।’ –মিশকাত: ২৩৫৪
মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘কবরবাসী ডুবন্ত আশ্রয়প্রার্থীর মতো। সে প্রতীক্ষায় থাকে- তার বাবা, মা, ভাই, বন্ধু প্রমুখ তাকে সাহায্য করে কি-না। তদ্রƒপ কবরবাসী প্রতীক্ষায় থাকে জীবিতরা তার কাছে উপহার পাঠায় কি-না। মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের উত্তম উপহার হলো- তার জন্য আল্লাহর কাছে ইসতিগফার করা।’ –বায়হাকি: ২৩৫৫