এমন কিছু আমল রয়েছে, যা আদায় করা খুব সহজ। কিন্তু আমাদের উদাসীনতার কারণে, খেয়াল না করার কারণে ওইসব আমলের ফজিলত থেকে আমরা বঞ্চিত হই। আজ এমন কিছু আমলের কথা উল্লেখ করা হলো-
আজানের উত্তর দেওয়া
আজানের উত্তর দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। হাদিস শরিফে এর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের গল্প-গুজব ও হাসাহাসিসহ নানা অপ্রয়োজনীয় কাজের ভিড়ে কখন যে আজান হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল থাকে না। অথচ হাদিসে আজানের উত্তর দেওয়ার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছেন, যখন মুয়াজ্জিনের আওয়াজ শোনো তখন মুয়াজ্জিন যেরূপ বলে তোমরাও সেরূপ বলো, অতপর আমার প্রতি দরূদ পড়ো। যে আমার প্রতি একবার দরূদ পড়ে আল্লাহতায়ালা তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করেন। এরপর আমার জন্য আল্লাহর নিকট ‘উসিলা’র দোয়া করো। ‘উসিলা’ জান্নাতের একটি বিশেষ মর্যাদা, যা আল্লাহর বান্দাদের মাঝে শুধু একজনকেই দেওয়া হবে। আমি আশা করি, সেই বান্দা আমিই হবো। যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘উসিলা’র দোয়া করবে, সে আমার শাফায়াতের হকদার হবে। -সহিহ মুসলিম
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি আরজ করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুয়াজ্জিনগণ তো আজর ও সওয়াবের হিসেবে আমাদের চেয়ে অগ্রগামী হয়েছেন (এমন কোনো আমল আছে কি, যার দ্বারা আমরাও মুয়াজ্জিনের মতো ফজিলত হাসিল করতে পারি?) হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, তোমরাও ওই বাক্যগুলো বলো, যেগুলো মুয়াজ্জিন বলে, এরপর আজানের জওয়াব শেষ করে দোয়া করো। তোমার দোয়া কবুল করা হবে।’ –সুনানে আবু দাউদ
মিসওয়াক করা
আরেকটি আমল হলো- মিসওয়াক করা। আমাদের আশেপাশে কিছু পরিবার আছে যারা এই সুন্নতের ওপর আমল করেন। মিসওয়াক সম্পর্কে অনেক হাদিস আছে এবং এতে দুনিয়াও আখেরাতের অনেক ফায়দা আছে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর হবে এই আশঙ্কা না হলে আমি তাদেরকে প্রত্যেক নামাজের সময় মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম (অর্থাৎ মিসওয়াক করা অপরিহার্য করে দিতাম)। -সহিহ মুসলিম
হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হজরত জিবরাইল (আ.) যখনই আমার নিকট আসতেন, আমাকে মিসওয়াকের তাকিদ করতেন। এমনকি আমার আশঙ্কা হতে লাগল যে, অত্যধিক মিসওয়াকের কারণে আমি নিজের মাড়ি না ছিলে ফেলি। -মুসনাদে আহমাদ
মিসওয়াক করার ফজিলত সম্পর্কিত আরও বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। চিন্তাশীলদের জন্য একটি হাদিসই যথেষ্ট।
কোরআনে কারিমের তেলাওয়াত
আমাদের অনেকেই নিয়মিত কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করেন না। এক্ষেত্রে সাংসারিক ঝামেলার কথা বলা হয়। কিন্তু এই ব্যস্ততার মাঝেও যদি নিয়মিত তিলাওয়াত করে যেতে পারি, তাহলে আমাদের সওয়াব হবে আরও বেশি।
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে মুমিন কোরআন শরিফ পাঠ করে, তার উদাহরণ যেন কমলা লেবু, যা খুশবুদার এবং সুস্বাদু। আর যে মুমিন কোরআন পাঠ করে না তার উদাহরণ যেন খেজুর, যার খুশবু নেই তবে স্বাদ মিষ্টি। আর যে মুনাফিক কোরআন পাঠ করে তার উদাহরণ যেন সুগন্ধি ফুল যাতে সুঘ্রাণ আছে তবে স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক কোরআন পাঠ করে না তার উদাহরণ যেন মাকাল ফল, যাতে ঘ্রাণও নেই স্বাদও তিক্ত। -সহিহ মুসলিম
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করে সে একটি নেকি পাবে, আর একটি নেকির বিনিময়ে দশটি নেকি দান করা হবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মিম এক হরফ, বরং আলিফ এক হরফ, লাম এক হরফ এবং মিম এক হরফ। -সুনানে তিরমিজি
কোরআনে কারিমের তেলাওয়াতের বিষয়ে আরও অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ওই সব হাদিসে বলা হয়েছে, কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত এবং আজর অন্য সব আমল থেকে বেশি।
নামাজ আদায়ে অলসতা
আরেকটি ভুল আমরা করি, যা সত্যিই পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, তা হচ্ছে নামাজ আদায়ে গাফিলতি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি ঠিক, কিন্তু আউয়াল ওয়াক্তের দিকে খেয়াল করি না। অনেক পরিবারে দেখা যায়, দুপুরের রান্নাবান্না শুরু হয় জোহরের আজানের সময়। রান্না শেষ হতে প্রায় তিনটা বেজে যায়। অনেক সময় তো আসরের ওয়াক্তের কাছাকাছি হয়ে যায়। কাজের সময় পরিবর্তনের মাধ্যমে এই উদাসীনতা দূর করা সম্ভব।
আরেকটি কথা, নামাজের সময় খুশু-খুজুর (একাগ্রতা) প্রতিও খেয়াল রাখা চাই। হজরত আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিকৃষ্ট চোর ওই ব্যক্তি, যে নামাজের মধ্য হতে চুরি করে। সাহাবারা (রা.) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! নামাজে কীভাবে চুরি করে? ইরশাদ করলেন, রুকু-সেজদা উত্তমরূপে আদায় করে না।
এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, প্রতিদিন আমাদের কত আমলের সুযোগ আছে, কিন্তু অবহেলা করে ছেড়ে দিচ্ছি। যেগুলো আদায় করছি, চিন্তা করা উচিত, কতটুকু যত্নের সঙ্গে আদায় করছি।
কথাবার্তায় সতর্ক থাকা
এবার অন্য একটি দিক সম্পর্কে বলি। তা হচ্ছে, কথার মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট দেওয়া। তাই জবানের বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। কোনো খবরের সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করে তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করা, একসঙ্গে বসে গীবত শেকায়েত ও অনর্থক কথাবার্তায় মশগুল থাকা পাপের কাজ। এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।
কোরআনে কারিমে মুমিনদের গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত’ অর্থাৎ এমন কথা, যার সঙ্গে ধর্মীয় কোনো উপকার নেই; বরং ক্ষতি। আর হাদিসের ভাষায় মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ছেড়ে দেয়, তখন তার ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়।