যে কোনো মানুষের পক্ষে মুসলিম হওয়া অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। এ কারণে বাংলাদেশের একজন সাধারণ মুসলিমও গর্ববোধ করে থাকেন। এমনকি কেউ ইসলামবিরোধী কিংবা ঈমান বিনষ্টকারী কোনো কাজ করলে, কিছু বললে- তার প্রতিবাদ করেন। এমন ঈমানি চেতনার মাঝেও বিভিন্নভাবে মানুষের মাঝে শিরক ছড়িয়ে আছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, ক্ষেত্রবিশেষ শিরক হয় ধর্মের নামে, ইসলামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে।
আমাদের দেশে এমন অনেক মুসলমান রয়েছেন, যারা নিজেদেরকে প্রকৃত সুন্নি বলে দাবি করে থাকেন। তারা শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ও মান-মর্যাদা বাড়ানোর জন্য এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, নবী করিম (সা.) জীবদ্দশায় যাবতীয় অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন, বর্তমানেও তিনি সর্বত্র হাজির-নাজির আছেন। সুদূর মদিনায় থেকেও তিনি সর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছু অবলোকন করছেন।
বস্তুত এ ধরনের বিশ্বাস, শিরকের অন্তর্গত। একমাত্র আল্লাহতায়ালা আর ছাড়া কারও পক্ষে নিজ থেকে গায়েব সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহতায়ালার অধিকারভুক্ত বিষয়। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রেসালতের দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায়ের প্রয়োজনে আল্লাহতায়ালা কিছু অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত করেছিলেন, এর বাইরে তিনি নিজ থেকে আর কিছুই জানতেন না।
গায়েব সম্পর্কে জানার যেমন নবী কমির (সা.)-এর জন্মগত কোনো বৈশিষ্ট্য ছিলো না, তেমনি রেসালত লাভের পরেও নবীকে (সা.) এমন কোনো বৈশিষ্ট্য দান করা হয়নি। তা না দেওয়ার কারণ হলো, বিষয়টি আল্লাহতায়ালার রুবুবিয়্যাতের সঙ্গে সম্পর্কিত স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিশেষ গুণ, যা আল্লাহ ব্যতীত কোনো সৃষ্টির জন্য শোভা পায় না। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবদ্দশায় এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না, ইন্তেকালের পরও না।
এমন ভ্রান্ত শিরকি বিশ্বাস পোষণকারীরা হয়তবা এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অসীম জ্ঞানের অধিকারী ও মর্যাদাবান বলে মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান। কিন্তু তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এ জাতীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক সম্মান প্রদর্শন করার অর্থ হচ্ছে, অধিকমাত্রায় শিরকে নিমজ্জিত হওয়া ও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
আফসোসের কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে এ জাতীয় শিরকি চিন্তাধারা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস কতিপয় তরীকতপন্থীদের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে। মারেফতের দাবিদার ভ্রান্ত তরিকতপন্থীরা এ জাতীয় ধারণা শুধু হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারেই পোষণ করে না, তারা অলি-আউলিয়া, পীর-বুজুর্গদের ব্যাপারেও এমন ধারণা পোষণ করেন।
তাদের ধারণা, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তা আল্লাহর অলিরা তাদের রূহানি শক্তিবলে জানতে পারেন। এ ধারণার ভিত্তিতে তারা দূর-দূরান্ত থেকে অলি-আউলিয়াদের ‘ইয়া গাউস’, ‘ইয়া খাজা’ ইত্যাদি বলে সাহায্যের আহ্বান করেন। এমনকি ভক্তির আতিশয্যে তাদের কাউকে আল্লাহর যাবতীয় গুলাবলী দ্বারা হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিকে (রহ.) গুণান্বিত করতেও দেখা যায়।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ভক্তদের যাবতীয় বিষয়ের ব্যাপারে সম্যক অবহিত। তিনি তাদের আহ্বান শ্রবণ করেন। অনেকে মনে করেন, হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর কবর থেকে ফয়েজ ও বরকত উপচে পড়ছে। সেখানে যে যে উদ্দেশ্যেই তাকে আহ্বান করে, তাদের সবার জন্যেই তার দু’হাত প্রশস্ত হয়ে রয়েছে। এভাবে ‘কেউ ফেরে না খালি হাতে, খাজা তোমার দরবার হতে’- এ বাক্যটি তার ভক্তদের নিকট একটি বিশ্বাসী স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর ব্যাপারে তার ভক্তদের ধারণা হচ্ছে, এক সময় আল্লাহ তার নবীকে সবকিছু পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এরপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিকে। যেমন তারা বলে থাকে- ‘খোদার ধন নবীকে দিয়া, খোদা গেলেন গায়েব হইয়া/নবীর ধন খাজাকে দিয়া নবী গেলেন খালি হইয়া, খাজারে তোর দরবার হতে কেউ ফিরে না খালি হাতে।’ এমন চিন্তা শিরক, এগুলো থেকে মুসলমানদের বেঁচে থাকতে হবে।
আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনিই একমাত্র গায়েব সম্পর্কে জানেন। কেননা গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহতায়ালা জানেন। আল্লাহ ছাড়া আর কারও পক্ষে নিজস্ব ক্ষমতায় অদৃশ্যের জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন, আল্লাহ ছাড়া আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না কখন তারা পুনরুত্থিত হবে।’ -সূরা নামল: ৬৫
কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তারই (আল্লাহর) কাছে অদৃশ্যের চাবিকাঠি রয়েছে। কেউ তা জানে না তিনি ছাড়া। আর তিনি জানেন যা আছে স্থলদেশে ও সমুদ্রে। আর গাছের এমন একটি পাতাও পড়ে না যা তিনি জানেন না আর কোনো শস্যকণা মাটির অন্ধকারে পতিত হয় না এবং কোনো আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না। সমস্ত বস্তুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।’ -সূরা আনআম: ৫৯
হাদিসেও এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। হজরত ইবনে উমর (রা.) সূত্রে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, গায়েবের চাবিকাঠি পাঁচটি। যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না। মাতৃগর্ভে কি গুপ্ত রয়েছে তা জানেন একমাত্র আল্লাহ এবং আগামীকাল কি সংঘটিত হবে তাও জানেন একমাত্র আল্লাহ এবং বৃষ্টিপাত কখন হবে তাও একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না এবং কে কোন ভূমিতে মারা যাবে তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে।’ –সহিহ বোখারি: ৬৮৭৫
পবিত্র কোরআন, সহিহ হাদিস এবং উলামায়ে কেরামের বাণী থেকে বুঝা যায় যে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েবের খবর জানতেন না। সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণা করবে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) অথবা পীর-মাশায়েখ, অলি-আউলিয়া কিংবা গণক-জাদুকর গায়েবের খবর জানেন, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।
শিরক হচ্ছে সব পাপের বড় পাপ। যা আল্লাহতায়ালা কখনোই ক্ষমা করবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে মারা যায় তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকতে হবে। শিরকের ভয়াবহতা এত বেশি যে, শিরক মানুষের সব আমল নষ্ট করে দেয়, মানুষকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়।
সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্যকোনো মানুষ, হোক নবী-রাসূল, বুজুর্গ- তিনি গায়েব জানেন এমনটা বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মানুষের মনের কথা জানেন এটা বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ যাকে চান, সন্তান দেন- অন্য কারও এই ক্ষমতা নেই। একমাত্র আল্লাহতায়ালাই মানুষকে রোগ থেকে সুস্থতা দান করতে পারেন, অন্য কেউ নয়। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ ইচ্ছা করলেই কোনো ভালো কাজ করতে পারবে বা কোনো খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারবে এমন মনে করা শিরক। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ কারও ক্ষতি করতে পারে এমনটা মনে করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে বা মারতে পারে এমন মনে করা শিরক। যদি কেউ মনে করেন, আল্লাহ ছাড়াও অন্য কোনো নবী-রাসূল, গাউস-কুতুব সর্বদা জীবিত রয়েছেন- তাহলে সে শিরক করছে। কোনো নবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, অলি-আউলিয়া বিশ্ব পরিচালনা করেন- একথা মনে করা শিরক। আল্লাহতায়ালা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই সময় বা যুগকে গালি দেওয়া গর্হিত কাজ।
একমাত্র আল্লাহতায়ালাই কারও অন্তরের পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। এর ব্যতিক্রমে বিশ্বাস করা শিরক। অনেক মাজার ও পীরের দরবারে অমাবস্যা, পূর্ণিমা, পীরের জন্ম বা মৃত্যু তারিখ নির্দিষ্ট করে ওরস হয়ে থাকে। বেপর্দা অবস্থায় নারী-পুরুষ একত্রে বসে জিকির করে, কাওয়ালি গান শোনে। ভন্ড পীর-ফকিররা এ সব ওরসে ওয়াজ নসিহতের নামে শরিয়তবিরোধী আকিদা-বিশ্বাস প্রচার করে। এসবে অংশ নেওয়া পাপ।
হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) কিংবা কোনো বাবা ভবিষ্যত জানেন, তার ভালো-মন্দ করার ক্ষমতা আছে- এটাও শিরক। আল্লাহর জিকিরের ন্যায় কোনো নবী-রাসূল, পীর-আউলিয়া, বুযুর্গের নাম জপ করা, বিপদের পড়লে তাদের নামের অজিফা পড়া। মাজারে শিন্নি দেওয়া, চাদর দেওয়া অনুরুপ শিরক।
সুতরাং আসুন, দুনিয়া এবং পরকালের মুক্তি লাভের জন্য শিরক থেকে মুক্ত থাকি।