মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো- ন্যায়বিচার, সাম্য ও ইনসাফ। মানুষের মানবিক মূল্যবোধের অবনতি ও অবক্ষয়ের অন্যতম প্রমাণ হলো- ইনসাফের দেউলিয়াত্ব। এ অবস্থা সমাজের সর্বত্র বিরাজমান। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ন্যায়বিচারহীনতা দৃশ্যমান। অথচ ইসলামে এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে সতর্ক করে ইরশাদ করেছেন, ‘পূর্ববর্তী জাতিগুলোর বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ, তারা ইনসাফ করত না।’
সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ঐচ্ছিক কোনো কর্মসূচি নয়, এটি অপরিহার্য একটি বিধান। বিভিন্ন কারণে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তার মধ্যে একটি হলো- স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতমূলক নীতি দর্শন। এ অবস্থায় অনেকেই নিরপেক্ষ থাকতে পারে না।
অথচ কোরআনে কারিমের বহু স্থানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয়েছে। আর ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারীরা আল্লাহর পছন্দের লোক। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচাকারীদের ভালোবাসেন।’
মানবিক মূল্যবোধের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, সব মানুষের প্রতি সুবিচার। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেকেক্ষেত্রে ওপর মহলের লোকেরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই তাদের ওপর আইন কার্যকর করা হচ্ছে। অথচ ন্যায়বিচারের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’
ন্যায়পরায়ণ খলিফা আল্লাহতায়ালার কাছে খুব প্রিয়। পক্ষান্তরে অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহতায়ালার কাছে খুবই ঘৃণিত। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ খলিফা কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবেন। আর অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ও সর্বাধিক শাস্তি প্রাপ্ত হবে। অধিকন্তু সে আল্লাহর দরবার থেকেও বহু দূরে অবস্থান করবে।’
অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়, কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক দিবসেও সে সব লোক আল্লাহতায়ালার ছায়া পাবে- তার অন্যতম হলেন- ন্যায়পরায়ণ শাসক। যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না।
অন্য একটি হাদিস থেকে জানা যায়, ন্যায়পরায়ণ লোকদের আল্লাহতায়ালা তার পাশে স্থান দেবেন।
ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার ফলে সৎকর্মশীল সব লোকের পক্ষে সুষ্ঠু জীবনযাপন অত্যন্ত সহজ হয় এবং আল্লাহর আইন লঙ্ঘন, আল্লাহর নিষিদ্ধ ও ঘৃণিত কাজ প্রভৃতি পরিহার করার পথে কোনো বাধা প্রতিবন্ধকতা থাকে না, বস্তুত মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের সঙ্গে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন না করে, ততক্ষণ অন্য লোকের প্রতি কোনো সুবিচার করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। নিজের যাচাই-পরীক্ষা নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় সে অন্যের সঠিক ও নির্ভুল যাচাই কী করে করতে পারে? সুতরাং সর্বপ্রথম নিজেকে দেখা, যাচাই-পরীক্ষা করা ও নিজের প্রতি সুবিচার ও ইনসাফ কায়েম করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। এটি করলে অন্যের অন্যায়ের যাচাই ও পরীক্ষা করা তার পক্ষে সহজ হতে পারে।
ন্যায়বিচারের জায়গা শুধু আদালত নয়। ইসলামে ন্যায়বিচার একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। এর দ্বারা সর্বত্র ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা বুঝায়। ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত হলো- সময়কে যথাযথ কাজে লাগানো, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একচোখে দেখা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সঠিকভাবে ব্যবহার, একাধিক স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি সমান আচরণ করা, ছাত্রছাত্রীদের সমান চোখে দেখা প্রভৃতি।
কিন্তু ন্যায়বিচার নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অবহেলা করে। যা আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন।’
ন্যায়বিচারের অভাবে অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর বিশেষত বনি ইসরাইলের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিল এটি। তারা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এক ধরনের বিচার করত, আবার অসহায় ও নিম্ন শ্রেণীর লোকদের জন্য আরেক রকম বিচার করত।
কোনো সমাজে সুবিচার না থাকলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের অরাজকতা দেখা দেয়। ন্যায়বিচারের অভাবে অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে যায়। নবী করিম (সা.) সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘যদি কোনো জাতির মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকে, তখন তাদের মধ্যে রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ে।’
সর্বোপরি যেকোনো বিবেচনায় সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাহলে অনেকাংশে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সবাই তার ন্যায্য অধিকার লাভ করবে।
ইসলামের বক্তব্য হলো- বিচার করলে ন্যায়বিচারের সঙ্গে করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে সবল, দুর্বল, ধনী-গরিব এবং শাসক-শাসিতের মধ্যে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখে। ফলে সামাজিক সংহতি ও কল্যাণ বৃদ্ধি পায়।