কবিরা গোনাহকারীদের অধিকাংশ যদিও নফসে তাড়িত হয়ে স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে গোনাহ করে। তবে তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ কখনও সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় চাপে কবিরা গোনাহ করতে বাধ্য হয়। তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীদের বড় অংশ যদিও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় রাত জাগরণ করে, তবে একটা অংশ কিন্তু লোক দেখানো ও পদ টিকানোর জন্য তাহাজ্জুদে দাঁড়ায়। এই শ্রেণির লোকেরা যে উদ্দ্যেশেই কবিরা গোনাহ করুক কিংবা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করুক- গোনাহকারী সমাজের চোখে ঘৃন্য; আর তাহাজ্জুদ আদায়কারী পুণ্যবান।
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় সমস্ত আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ (পরকালে) তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার রাসুলের উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তার হিরজত আল্লাহ এবং তার রাসুলের উদ্দেশেই হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়া হাসিলের কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তার হিজরত সেই উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে যে উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে।’ -সহিহ বোখারি
বর্ণিত হাদিসের সঙ্গে একটি ঘটনা রয়েছে। সেটা হলো- মুসলমানরা মক্কার মুশরেকদের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আল্লাহর হুকুমে মদিনায় হিজরত করেন। সবার উদ্দেশ্য ছিল, মদিনায় সহজভাবে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করা। কিন্তু তাদের মাঝে এক লোক হিজরতকারী এক নারীকে বিয়ের জন্য সবার সঙ্গে হিজরত করে। এ কথা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জানার পর বলেন, ‘যে আল্লাহ ও তার রাসুলের উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে, তার হিজরত সে হিসেবে গণ্য হবে, অর্থাৎ তারা উত্তম বিনিময় পাবে। আর যে দুনিয়া লাভ কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত সেভাবেই গ্রহণ করা হবে, পরকালে তার কোনো বিনিময় থাকবে না।
পৃথিবীতে মানুষ হরেক নিয়তে কাজ করেন। কেউ জ্ঞানার্জন করে জ্ঞানীরূপে নিজেকে জাহিরের জন্য, কেউ লেখালেখি করে নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচিতির জন্য। কেউ হজ করে আলহাজ হতে, কেউ দান করে দানবীর হতে, কেউ পীর হয় হাদিয়া পেতে, কেউ দরবেশ হয় ভন্ডামী করতে। বিচিত্র পৃথিবীতে কাজের ধরণ এক, উদ্দেশ্য আরেক।
কেয়ামতের দিন তিনজনকে প্রথমে আগুনে ফেলে দেওয়া হবে। এরা হলো- জ্ঞানী, মুজাহিদ ও দাতা। আল্লাহ আলেমকে প্রশ্ন করবেন, তুমি দুনিয়ায় কী করেছ? সে বলবে, আমি আপনার জন্য জ্ঞানার্জন করেছিলাম ও আপনার সন্তুষ্টির জন্য সেই জ্ঞান দান করেছি। তখন তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি জ্ঞানার্জন করেছো যেন তোমাকে জ্ঞানী বলা হয়। তুমি যা চেয়েছিলে তা দুনিয়াতে পেয়েছ। তখন তাকে দোজখে নিক্ষেপের আদেশ দেওয়া হবে।
দানবীরকে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, তুমি দুনিয়ায় কী করেছো? সে বলবে, আপনার জন্য হালালভাবে সম্পদ অর্জন করেছি ও দান করেছি। তখন তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি সম্পদ দান করেছো যেন তোমাকে দাতা বলা হয়। তুমি যা চেয়েছিলে তা দুনিয়ায় পেয়েছ। তখন আদেশ করা হবে তাকে দোজখে দেওয়ার।
তদ্রুপ মুজাহিদকে প্রশ্ন করা হবে, তুমি দুনিয়ায় কী করেছিলে? সে বলবে, আমি মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করেছি, তখন তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি এজন্য লড়াই করেছ যেন তোমাকে বীরযোদ্ধা বলা হয় ও তাই হয়েছে। তুমি দুনিয়াতেই তোমার বিনিময় পেয়েছ। এরপর তাকেও দোজখে নিক্ষেপের আদেশ দেওয়া হবে।
মানুষ যেসব কাজ করে, তা অন্তত তিনটি স্তরে সম্পাদিত হয় মানুষের অন্তরে। অন্তরের এই তিনটি ধাপ অতিক্রম না করে কোনো কাজ হওয়া সম্ভব নয়। কারও মনে যে কাজের কোনো ধারণা নাই, যে কাজ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না, যে কাজ করার সিদ্ধান্ত অন্তরে নেই- তার পক্ষে সে কাজ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। মনের তিনটি স্তরের চূড়ান্ত স্তর হলো- নিয়ত। সবকাজের ক্ষেত্রে এই নিয়তই মূল বিষয়। কারণ নিয়তটাই কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি। আর নিজের কাজটাকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করার নাম হলো- ইখলাস এবং ইখলাস ইমানের অংশবিশেষ। মুমিন ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি কাজ হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত। এটাই ইখলাস কিংবা একনিষ্ঠতার মূল কথা।
মুমিন বান্দা তার আমলের সওয়াব কতটুকু পাবে, তা নির্ভর করে তার নিয়তের ওপর। অর্থাৎ নিয়ত দ্বারা আমলের মান নির্ধারিত হয়। বস্তুত নিয়তগুণে কর্ম, হাদিসটি বিশেষভাবে ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ ছোট্ট একটা ভালো কাজ নিয়তের কারণে সীমাহীন সওয়াব এনে দেয়। আবার অনেক বড় ইবাদতও গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হজরত আবু উমামা বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ কেবল বান্দার সে আমলকেই গ্রহণ করবেন, যা একমাত্র তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত এবং যে আমলটা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।’ –নাসাঈ
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের চেহারা ও সম্পদ দেখেন না, তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর এবং তোমাদের আমল।’ –সহিহ মুসলিম
নিয়তের বিশুদ্ধতা বান্দার আমলকে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। বিষয়টি হাদিসে বলা হয়েছে এভাবে, ‘এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! ইমান কি? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইখলাসই হলো- ঈমান।’ –বায়হাকি
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তির নিয়ত, তার আমল অপেক্ষা উত্তম।’ আসলে নিয়ত হলো- অন্তরের আমল। আর নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল অন্তরের আমলকে প্রকাশ করে। অন্তরের আমল হয় আগে এবং অন্তরের আমলের পথ ধরেই আসে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল। তাই অন্তরের আমল তথা নিয়তের মূল্যই বেশি। তাই আল্লাহতায়ালা বান্দাকে অন্তরের আমলকে পরিশুদ্ধ করতে আদেশ করেছেন।