আমাদের সমাজে বিনাপ্রয়োজনে আত্মপ্রশংসা এবং স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যের প্রশংসা করার রীতি চালু আছে। বিশেষ করে, কারও কাছ থেকে কিছু আদায় করতে চাইলে কিংবা অন্যকে ছোটো করতে চাইলে মানুষ এই কাজগুলো করে। আমরা মনে করি, শুধু দান-খয়রাত করে বলে বেড়ানোর কথা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিষয়টি তা নয়। দান-খয়রাত ও বিভিন্ন আমল এবং ইবাদত-বন্দেগি করা হয় আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য। এগুলো বান্দার একান্ত বিষয়, তাহলে এগুলো কেন সবসময় বলে বেড়াতে হবে? নিজের প্রশংসার অনেকগুলো পদ্ধতি সমাজে প্রচলিত আছে। এর অন্যতম হলো-
অন্যকে অনুপ্রাণিত করার আড়ালে নিজের কথা জাহির
এক. আমি আগে বেনামাজি ছিলাম, এখন আমি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রতিদিন পড়তে পারি, তুমিও পারবে।
দুই. আমিতো কখনও পর্দাই করতাম না। এখন আমি যদি পরিবর্তন হতে পারি তুমিও পারবে।
তিন. আগে তো আমি সবসময় রাতে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতাম। এখন প্রতিদিনই তাহাজ্জুদ পরি। আমি পারলে, তুমি কেন পারবে না।
চার. আমি যদি ভদ্র হতে পারি, তুমি কেন পারবে না। আগে আমি তোমার থেকে বেশি অভদ্র ছিলাম।
নিজেকে সবজান্তা প্রমাণ করতে
যারা নিজেদের প্রশংসায় ব্যস্ত থাকে, তাদের উদ্দেশ্য হলো- ‘আমি সব জানি,’ ‘আমার অনেক জ্ঞান,’ ‘এটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না’- এটা জাহির করা। এক কথায়, নিজেকে ‘সবজান্তা’ প্রমাণ করা।
অন্যকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে
আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা কথায় কথায় অন্যকে নিয়ে মজা করতে পছন্দ করেন। অন্যকে নিয়ে মজা করতে যেয়ে, নিজেকে বড় প্রমাণের জন্য আত্মপ্রশংসায় লিপ্ত হন। সত্য-মিথ্যার মিশেলে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করতে দেখা যায় অনেককে। যা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
আমিই সঠিক এটা বুঝাতে
আরেকটি প্রবণতা হলো, কেউ কেউ মানুক বা না মানুক; অনেকেই মনে মনে নিজেকে বিশেষ ব্যক্তিত্ব ভেবে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির জাবর কাটেন- এটাও মন্দ অভ্যাস ও ভুল বিষয়। তেমনি ভুল হলো, নিজ দলের প্রশংসা করে একমাত্র নিজ দলকে হকপন্থী বলে দাবি করা। শুধুমাত্র আমি, আমার দল ও আমার নেতাই একনিষ্ঠ-সত্যবাদী মনে করা। ইসলামের শিক্ষা হলো, কেউ নিজেকে দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করবে না। আত্মপ্রশংসা ও নিজেকে ত্রুটিমুক্ত মনে করা বৈধ নয়।
আত্মপ্রশংসা ও আত্মপ্রচার নিষিদ্ধের কারণ
আত্মপ্রশংসা ও আত্মপ্রচার নিষিদ্ধের অনেক কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো- অধিকাংশক্ষেত্রে আত্মপ্রশংসার কারণ হয় অহমিকা ও আত্মগর্ভ। কাজেই সদম্ভে আত্মপ্রশংসা ও আত্মপ্রচারে লিপ্ত হওয়া যাবে না। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা সামনে প্রশংসাকারীদেরকে দেখতে পাও, তখন তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করো।’ –সহিহ মুসলিম : ৭৩৯৬
দ্বিতীয়ত, কারও শেষ পরিণতি কী হবে, তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে পবিত্র দাবি করো না। আল্লাহ অধিক অবগত তোমাদের মধ্যে কে পবিত্র।’ -সহিহ মুসলিম : ৫৫০২
কাজেই নিজেকে পূত-পবিত্র বলে আখ্যায়িত করা আল্লাহভীতির পরিপন্থী। অতএব, আল্লাহর ভয় থাকলে আত্মপ্রচারে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনি ভালো জানেন কে তাকওয়া অবলম্বন করেছে।’ –সুরা আন নাজম : ৩২
তৃতীয়ত, নিজেকে দোষ-ত্রুটিমুক্ত মনে করা বা প্রচার করা মিথ্যা বৈ কিছু নয়। কেননা প্রতিটি মানুষের মাঝেই অসংখ্য ত্রুটি-বিচ্যুতি বিদ্যমান।
আত্মপ্রশংসা কেন নিষেধ?
এখন প্রশ্ন হলো, কেন এবং কোন কারণে আত্মপ্রশংসাকে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগণ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন? যদিও এতে মানুষের জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনার অনেক কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে উল্টো। যাকে আমরা প্রশংসা করে অথবা নিজের ভালো কাজের কথাগুলো বলে অনুপ্রাণিত করতে চাই- সে আমাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা করতে থাকে এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে গোনাহের পথে পা বাড়ায়। এই কাজ সমাজে হিংসার দাবানল জ্বালিয়ে দেয়।
আবার বিপদে পরে কেউ কারও কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তাকে আগেই ঠিক করে নিতে হয়, কি বলে সাহেবের গুণগান শুরু করতে হবে। যাতে সে অন্যের থেকে আমাকে বেশি সাহায্য দেয়।
তাহলে দেখুন, সে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনার প্রশংসা করছে না। আপনাকে বোকা বানাচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে ‘পাম দেওয়া।’ আপনার থেকে সাহায্য নেওয়া হয়ে গেলে, আড়ালে দু’টো বকা দিতেও তার দ্বিধা হয় না।
সব কথা বলে বেড়াতে হয় না
কোনো আমল কিংবা ইবাদত করে বলে বেড়ানো নিষেধ। এর মধ্যে রিয়া তথা লৌকিকতা রয়েছে- যা ইসলামে নিষিদ্ধ। এটাকে ছোট শিরক বলা হয়। এগুলো প্রচারের ফলে নিজের অজান্তে মনে অহঙ্কার সৃষ্টি হয়। ইবাদতের একনিষ্ঠতা নষ্ট হয়।
আত্মপ্রশংসা নিন্দনীয় অপরাধ
আত্মপ্রশংসা একটা নিন্দনীয় অপরাধ। ইসলামে আত্মপ্রশংসা নিষিদ্ধ, আত্মপ্রশংসায় মনে অহঙ্কার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন লোককে পছন্দ করেন না, যে বড় হওয়ার গৌরব করে ও অহঙ্কার করে।’ -সুরা আন নিসা : ৩৬
অন্যকে বলে বেড়ানো আমল আল্লাহ কবুল করেন না। কোরআনে কারিমে বলা হচ্ছে, ‘তাদের কেবল একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ –সুরা বাইয়্যেনা : ৪-৫
কেয়ামতের দিন তার আমলের কোনো দাম থাকবে না, ‘আল্লাহ বলেন, তোমরা যা চেয়েছো, পৃথিবীতে তাই পেয়েছো সুতরাং আজ আমার কাছে তোমাদের কোনো প্রাপ্য নেই।’ –সহিহ মুসলিম : ৩৫২৭
আমল প্রদর্শন করা বা তা বলে বেড়ানোকে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট শিরক বলেছেন এবং এই বিষয়ে তিনি আমাদের জন্য সবচাইতে বেশি ভয় পেয়েছেন। ‘আত্মপ্রদর্শনকারীকে আল্লাহ নিন্দা করেছেন।’ -সুরা মাউন : ৪-৭
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই প্রদর্শনপ্রিয়তা হারাম। প্রদর্শনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।’
আত্মপ্রশংসা না করেও অন্যকে অনুপ্রাণিত করা সম্ভব
অনেকেই বলেন, এগুলো আত্মপ্রশংসা নয়- নিজের জীবনের ঘটনা থেকে বলে অনুপ্রেরণা দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো- আত্মপ্রশংসা না করেও অন্যকে অনুপ্রাণিত করা সম্ভব। যেমন-
এক. নবী-রাসুলদের জীবনী থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া। সাহাবিদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া।
দুই. নেককার বান্দাদের উদাহরণ দিয়ে কথা বলা। ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, এমন অনেক আল্লাহর প্রিয় বান্দা আছেন- যারা আমাদের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়।
তিন. যে কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আপনি মানুষের সামনে নিজের প্রশংসা করছেন, তখন নিজের প্রশংসা না করে ওই বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে অন্য একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝাতে চেষ্টা করুন।