মালদ্বীপ। ১১৯২ দ্বীপের দেশ। তন্মধ্যে লোক বসতি রয়েছে ১৮৭ দ্বীপে। শতভাগ মুসলমানের এই দেশের মনেপ্রাণে ধর্মপালন করেন। বলা চলে ধর্ম পালনে মনোযোগ বেড়েছে মুসলমানদের। রাজধানী মালেসহ পাশের বিলিকিলি, হুনহুমালে বা আরেকটু দূরের মাফুশি দ্বীপে গেলেই দেখা মেলে মাথায় স্কার্ফ কিংবা হিজাব পরা মালদ্বীপের মেয়েদের। ভারতীয় মহাসাগরের এই দেশে প্রায় ৯৬ ভাগ নারীই হিজাব পরে রাস্তায় বের হন। তাদের এই হিজাব পরে চলাটা ২০০৪ সালের সুনামির পর। এমনটাই জানিয়েছেন মালদ্বীপ প্রবাসী বাংলাদেশি ও স্থানীয়রা।
পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তাণ্ডব চালানো ওই সুনামিতে মালদ্বীপে ১০৯ জন মারা যায়। এর মধ্যে ১০২ জন স্থানীয়। সাতজন বিদেশি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সামান্য ওপরে (১.৫ মিটার বা ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি) অবস্থিত এই দেশের মানুষ সুনামির পর অনুধাবন করতে থাকে, যেকোনো মুহূর্তে তাদের দেশে এমন সুনামি ফের আঘাত হেনে সব শেষ করে দিতে পারে। তাই এরপর থেকেই মালদ্বীপের স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যাপকভাবে জেগে উঠে। নারীদের পর্দা করে চলাটা এরপর থেকেই।
সুনামিতে মালদ্বীপের ছয়টি দ্বীপ ধ্বংস হয়ে যায়। ৫৭টি দ্বীপ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৪টি দ্বীপ জনশূন্য করতে বাধ্য হয় সরকার। ২১টি রিসোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের ৪০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল, যা মোট জিডিপির ৬২ ভাগ। সেই সুনামিতে মালে শহরও ডুবে গিয়েছিল। তবে সুনামি কোনো আঘাত হানেনি নয়টি দ্বীপে।
মালদ্বীপের নারীদের মধ্যে কেউ পুরো শরীর কালো বোরকায় ঢাকা। কেউ শরীরের ওপরের অংশ ঢেকে রাখেন। কেউবা শরীরের সঙ্গে লেগে থাকা পোশাকের সঙ্গে শুধু মাথায় স্কার্ফ পরেন।
শুধু নারীরাই নয়, ২০০৪ সালের সুনামির পর মালদ্বীপের পুরুষরাও ব্যাপক হারে মসজিদমুখী হয়েছেন। যা এখনও বর্তমান। মালেতে নামাজের সময় হলেই সব দোকানপাঠ বন্ধ রাখা হয়। অবশ্য কোনো কোনো দোকানি দরজার সামনে ‘ক্লোজড’ (বন্ধ) প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে ভেতরে দোকানের কাজ চালাতে থাকে।
মালে শহরের এক নারীর দাবি, মালদ্বীপের নারীরা আগে থেকেই পর্দা করেন। কিন্তু পর্দা করার হার সুনামির পর থেকে বেড়েছে। এখন তা শতভাগের কাছাকাছি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মুসলমানের এই দেশে সুনামির আগে মানুষ এতটা ধর্মপ্রাণ ছিল না। বরং বেহায়াপনা আর নানা ধরনের অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতো। দিনের বেলায় যেকোনো একটু নিরিবিলি স্থানে ব্যভিচারে লিপ্ত হতো নানা বয়সের নারী-পুরুষ। পর্যটনকেন্দ্রিক দেশ হওয়ায় অনেক নারী ব্যভিচারকে আয়ের মাধ্যম করে নিয়েছিল। সেই দৃশ্য এখন আর আগের মতো নেই।
মালদ্বীপের এক সাংবাদিক ওজোনেও তা স্বীকার করেন। তার মতে, সুনামির পর সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের সময় আলেম সমাজের ব্যাপক ইসলাম প্রচার মালদ্বীপবাসীদের ধর্মমুখী করে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের আমলে কোনো আলেমকে ইসলাম নিয়ে বয়ান করার জন্য সরকারি অনুমতি নিতে হতো। এই অনুমতি পেতে লেগে যেত দু’বছর। নাশিদ সরকার এই বিধি-নিষেধ তুলে দেন। ফলে আলেম সমাজ যেকোনো উন্মুক্ত স্থানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে মানুষকে ইসলাম মেনে চলার তাগিদ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশটির মসজিদগুলোতে নামাজের সময় পরিপূর্ণ হতে থাকে। পুরোদমে চলে দাওয়াতে তাবলিগের কাজ। এমনকি দেওবন্দি ধারার বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেছে।
মালে শহরে কিছু নারী আধুনিক পোশাক পরলেও দ্বীপগুলোতে এখন আর হিজাব ছাড়া কোনো নারী দেখা যাবে না। মালদ্বীপের মেয়ে বা মায়েরা সমুদ্র বিচে নামলেও বোরকা পরেই নামেন।
মালদ্বীপ বিদেশী পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের জন্য খুবই প্রিয় জায়গা। পশ্চিমা দেশের পর্যটকরা এই দেশে এসে স্বল্প পোশাক পরেই নেমে পড়েন সাগরে। তবে মালেতে এই স্বল্প পোশাক পরে কেউ বিচে যেতে পারবে না। বিশেষ করে নারীরা। বিচের পাশে লেখা সাইনবোর্ডে- ‘নো বিকিনি’।
মালদ্বীপের আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা তিন লাখ ৯২ হাজার ৪৭৩। মালদ্বীপের সংবিধান মোতাবেক দেশটির নাগরিক হতে হলে মুসলিম হওয়া আবশ্যক। ফলে অমুসলিম কোনো নাগরিক সেখানে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের তথ্যমতে, আরব নাবিক-বণিকদের হাত ধরেই মালদ্বীপে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন।
১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই দ্বীপে কোনো মুসলমান ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২০০ খ্রিস্টাব্দে আবুল বারাকাত নামের এক মরোক্কান (ভিন্ন মতে, পারস্যের তাবরিজের অধিবাসী) মালদ্বীপে এসেছিলেন। তিনি মালদ্বীপের রাজাকে দাওয়াত দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করালে একসময় দ্বীপের সব মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মালদ্বীপের মানুষের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ বিষয়ে আরও চমকপদ্র চমকপ্রদ ঘটনা লোকেমুখে প্রচলিত।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের পাশাপাশি মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির জন্য মালদ্বীপে রয়েছে ছোট বড় অনেক মসজিদ। তবে রাজধানি মালেতে মসজিদের সংখ্যা বেশি। ২০১৮ সালে মালেতে উদ্বোধন করা হয় মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় মসজিদ কিং সালমান মসজিদ। নান্দনিকতায়ও এটি অদ্বিতীয়। এ মসজিদে একসঙ্গে ১০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। ২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। যার পুরো অর্থ এসেছে সৌদি আরব থেকে। আর তাই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানের নামে।
মসজিদ কমপ্লেক্সটি ছয় তলাবিশিষ্ট। নীল ঝলমলে গম্বুজাকৃতির ছাদ। চারপাশে সুদৃশ্য চারটি মিনার। রাতের মসজিদটির আলোকসজ্জা চোখধাঁধানো। আদর্শ এ মসজিদ কমপ্লেক্সে রয়েছে আন্তর্জাতিক গ্রন্থাগার, কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র, সুবিশাল সেমিনার কক্ষ, মুসল্লিদের বিশেষ শ্রেণিকক্ষ এবং গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ৪৪ হাজার বর্গফুটের বিস্তৃত চত্বর।
রাজধানী মালের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত নান্দনিক এ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে মালদ্বীপের সর্ববৃহৎ মসজিদ ছিল ‘মসজিদ-আস-সুলতান মুহাম্মদ তাকুরুফানু আল আজম।’ এটি দেশটির জাতীয় ইসলামি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে একসঙ্গে অন্তত পাঁচ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন এ মসজিদ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় মসজিদের স্বীকৃতি পায়।
মালদ্বীপের ঐতিহাসিক জুমা মসজিদ স্থানীয়ভাবে যাকে ‘হুরুকু মিস্কিয়া’ বলা হয়, সেটাও এক ঐতিহাসিক মসজিদ। প্রবাল মসজিদ নামে পরিচিত মসজিদটি ১৬৫৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। মালদ্বীপের সবচেয়ে পুরোনো ও অলংকৃত মসজিদটি শহরের কাফু আটোলে অবস্থিত। ইউনেস্কো ২০০৮ সালে এ মসজিদটিকে ‘সমুদ্র সংস্কৃতি স্থাপনা’ হিসেবে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সংস্কৃতির তালিকাভূক্ত করে।